জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি পর্যায়েও জনসভা ও ত্রাণ বিতরণসহ নানা কারণে বেশ কয়েকবার নাটোরে আসেন। তন্মধ্যে ১৯৬০-৬৩ সালের দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে তিনি নাটোরে আসেন। সেবার নাটোর কানাইখালী মাঠের দক্ষিণ গোল পোস্টের ১৫/২০ হাত সামনে তাঁদের জনসভার জন্য বেশ বড় ধরণের স্টেজ স্থাপণ করা হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে খয়রাত হোসেন, শেখ মুজিবুর রহমান, সাবেক চীফ মিনিস্টার আতাউর রহমান খান, চীফ মিনিস্টার আবুল হোসেনসহ অনেকেই সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬৭ সালের কোনো একদিন ‘খুলনা মেল ট্রেন’ যোগে পার্বতীপুর থেকে প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে নাটোর রেল স্টেশনে নামেন। এরপর তিনি ওখান থেকে রিক্সা যোগে সরাসরি নাটোর সি.এন্ড.বি-র ডাক বাংলো-তে ওঠেন । তারপর নাটোর এন.এস. কলেজের ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ এবং মহকুমা আওয়ামী লীগের কর্মকর্তাদের সাথে সেখানে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা সারেন তিনি। তখন নাটোর এন. এস. কলেজের পক্ষ থেকে ভিপি রেজা-উন-নবী, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম এবং প্রমদ সম্পাদক এনামূল হক-ও সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন । অপরদিকে নাটোর মহকুমা আওয়ামী লীগের পক্ষে মরহুম আশরাফুল ইসলাম, প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী, মরহুম সৈয়দ মোতাহার আলী, মরহুম রমজান আলী প্রামানিক,মরহুম রব্বু খান চৌধুরী,মরহুম আ.খ.ম.আনিস শেখ,মরহুম গোলাম কিবরিয়া, মরহুম ওয়াজেদ আলী দুলু, মরহুম সিদ্দিক হোসেন, মরহুম রহমত উল্লাহ সরকার বাদলসহ অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এসময় তাঁর সফর সঙ্গী ছিলেন কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মনসুর, তাজউদ্দিনসহ আরও অনেকে। নাটোর সি এন্ড বি-র ডাক বাংলোর অনুষ্ঠান শেষে তিনি একা রিক্সার ওপর দাঁড়িয়ে দীর্ঘপথের পাশে দাঁড়ানো জনতার উদ্দেশে হাত নাড়তে নাড়তে নাটোর শহরের মধ্যে দিয়ে কানাইখালী মাঠ অভিমুখে রওনা হন। তাঁর সফর সঙ্গীরা, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সমর্থকরা তখন পায়ে হেঁটে তাঁর রিক্সাটিকে অনুসরণ করতে থাকেন। সেদিন জনসভায় বক্তব্য রাখার জন্য কানাইখালী মাঠের পূর্বাংশে ‘দ’ আকৃতি বিশিষ্ট স্থানের সামনে ছোট্ট একটি স্টেজ নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন কানাইখালী মাঠের উত্তর-পশ্চিম কোণ দিয়ে মাঠে প্রবেশের জন্য একটি সরু রাস্তা ছিল। তিনি রিক্সা থেকে সেই রাস্তার কাছে নামেন। এরপর কয়েকজন সঙ্গিসহ সেই পথ দিয়ে হেঁটে যেয়ে কানাইখালী মাঠে নির্মিত সেই স্টেজে ওঠেন তিনি। তারপর একপর্যায়ে জনতার উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন তিনি ।
১৯৬৯ সালের কোনো একদিন বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে ছয়টার মধ্যে রেক্সিনের হুড বিশিষ্ট এক সবুজ রঙ্গের জিপে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা থেকে নাটোর পৌঁছেন। তিনি ওঠেন নাটোর কানাইখালীতে ঢাকা রোড সংলগ্ন সাবেক এম.পি.এ. কাঁচু উদ্দিন মোক্তার-এর বাসায়। তৎপ্রেক্ষিতে কাঁচুউদ্দিন মোক্তার কানাইখালী মাঠে ফুটবল খেলারত আমার বাল্যবন্ধু রমজান আলী প্রামানিক-কে ডেকে নিয়ে তার হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে, তাকে ১ সের কাঁচাগোল্লা এবং সিঙ্গারা আনতে বাজারে পাঠান তিনি। রমজান প্রামানিক ৩ টাকা দিয়ে ১ সের কাঁচাগোল্লা ও ৪ আনা দামের ১৩টি সিঙ্গারা সদায় শেষে দ্রুত কাঁচু উদ্দিন মোক্তারের হাতে তা বুঝিয়ে দেয় সে। সদায় শেষে বেঁচে যাওয়া অর্থ বখশিশ পায় রমজান আলী প্রামানিক। তারপর সে দৌড়ে মাঠে এসে পুনরায় আমাদের সাথে ফুটবল খেলায় অংশ গ্রহণ করে। ওই দিন বঙ্গবন্ধুর সাথে ছিলেন তাজউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মনসুর, কামরুজ্জামান ও তাঁর গাড়ির ড্রাইভার। সকলের পরনে ছিল পাঞ্জাবী ও পায়জামা। কাঁচুউদ্দিন মোক্তার-এর সেই বাসার দুটি জানালা ছিল ঢাকা রেডের দিকে। খেলা শেষে আমরা দেখেছিলাম যে, কাঁচুউদ্দিন মোক্তার-এর সেই বাসায় অতি গরমের কারণে তখন তাঁরা পাঞ্জাবী খুলে কেবল গেঞ্জি গায়ে দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে সিলিং ফ্যানের বাতাস খাচ্ছিলেন এবং সে সময় তাঁদের কেউ কেউ হাত পাখাও হাঁকাচ্ছিলেন । তার পরেই তাঁরা নাস্তার কাজটি সারেন এবং ওখানেই রাতের খাবার খান এবং রাত্রী যাপনও করেন। রাতের খাবার খেতে খেতে বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই কাঁচু! বৌ-মাকে বলিস, সকালে যেনো আউসের চালের খিঁচুড়ি আর ডিম ভাজি করে। আমরা কিন্তু সকালেই রাজশাহী চলে যাব।” কাঁচু উদ্দিন মোক্তার সেই মতোই ব্যবস্থা নেন । সকালের খাওয়া-দাওয়া শেষে তাঁরা রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হন । ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহা-কে পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা গুলি করে হত্যা করে। সম্ভবত সেই ঘটনার জন্যই তিনি সেদিন স্বদলবলে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে যান বলে ধারণা করা যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭০ সালের বৈশাখ মাসে সকাল দশটা থেকে এগারোটার মধ্যে নাটোর পৌঁছেন এবং নাটোর বোর্ডিং হাউসে ওঠেন তিনি । ওখানে স্বল্পকালীন বিশ্রামের পর সিংড়ায় সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের মাঝে ত্রাণ বিতরণের উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় সাড়ে বারোটার দিকে সিংড়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সিংড়ায় পৌঁছলে, কাউন্সিল মুসলিম লীগের ‘চৌগ্রাম ইউয়িন পরিষদ’-এর চেয়ারম্যান ফজলার রহমান তাঁকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন । সেদিন সিংড়ার ডাক বাংলোতে ওঠেন তিনি।তারপর তিনি সিংড়া বাজারের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন এবং দুর্গতদের মাঝে ত্রাণবস্ত্র বিতরণ করেন তিনি। এরপর সিংড়া ডাকবাংলোতে ফিরে আসেন এবং ওখানে তাঁর সম্মানে আয়োজিত লাঞ্চে সফর সঙ্গীদের নিয়ে অংশ গ্রহণ করেন তিনি । সেদিন সিংড়া থেকে প্রায় বিকাল তিনটার দিকে নাটোর বোর্ডিং হাউসে ফিরে আসেন তিনি । সে সময় তার সফর সঙ্গী ছিলেন তোফায়েল আহম্মদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির মহিলা বিষয়ক সাধারণ সম্পাদিকা নুরজাহান মোর্শেদ, নাটোরের সাইফুল ইসলাম, সিংড়ার মরহুম আশরাফুল ইসলাম, নাটোর শহরের হাফরাস্তার মজিদ খান, ফৌজদারীপাড়ার মরহুম আমিনুল ইসলাম গুন্টু, ফৌজদারীপাড়ার আকরাম হোসেন পচু, ফৌজদারীপাড়ার নাজমুল হক লালা,গাড়ীখানার মজিবর রহমান রেজা, ফৌজদারীপাড়ার শেখর দত্ত, কান্দিভিটার মজিবর রহমান সেন্টু, চৌধুরীবাড়ীর সেলিম চৌধুরী, উত্তর আলাইপুর এলাকার গোলাম মোস্তফা, আবুল ফজলসহ আরও অনেকে ।