দিনাজপুরের বড়মাঠ, বোস্তান সিনেমা হল, আমবাড়ি এবং ফুলবাড়ি এবং মুন্সিপাড়ায় বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও গণতন্ত্রের দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে আয়োজিত বিরোধী দলসমূহের কনভেনশনে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করেন। অন্যান্য বিরোধী দল ছয় দফার বিরোধিতা করলে তিনি কনভেনশন বয়কট করে ফিরে আসেন এবং ২৩ মার্চ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা উপস্থাপন করেন। তিনি দলের নেতৃবৃন্দকে সঙ্গে নিয়ে সারা দেশে ছয় দফার পক্ষে সভা ও সমাবেশ করতে থাকেন । ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ হতে ৮ মে পর্যন্ত সারাদেশে ৩২টি জনসভায় জনগণের সামনে ছয় দফার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। ছয় দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, তেঁতুলিয়া সফর করেন। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দিনাজপুর বড় মাঠে ছয় দফার পক্ষে জনসভা করা হয়। জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সভাপতিত্ব করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. রহিমউদ্দিন আহমেদ। সভা পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক এড. আব্দুর রহমান চৌধুরী। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, পরবর্তী সময়ে এই দুই নেতা ছয় দফার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে ভিন্ন দলে যোগ দেন। দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদকের পদত্যাগে দল সাময়িকভাবে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় । তবে এড. আজিজুর রহমান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম আব্দুর রহিম, আজিজুল ইসলাম জগলুসহ দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে যাওয়ায় গণমানুষের সমর্থনে অল্প দিনেই দিনাজপুরে দল শক্তিশালী হয়ে উঠে।
ছয় দফা জনগণের মাঝে দ্রুত জনপ্রিয় হয়। এ কারণে বঙ্গবন্ধুকে ঘায়েল করতে ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এই মামলার আসামি ও গ্রেফতার করা হয়। মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে জনগণ ফুঁসে উঠলে সংঘটিত হয় গণঅভ্যুত্থান। ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের মুখে সরকার ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। গণঅভ্যুত্থানে সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খানেরও পতন ঘটে। কারামুক্তির পর বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলা সফর করেন। ১৯৬৯ সালে বোস্তান সিনেমা, লিলি সিনেমা ও মডার্ণ সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠন সমূহের ৩টি পৃথক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। প্রতিটি সমাবেশ এক ঘণ্টা করে হয় বলে জানান তৎকালীন ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা দিনাজপুর শহরের মুন্সীপাড়া নিবাসী মোজাফফর হোসেন খান (মজু খান)। বোস্তান সিনেমা হলের কর্মী সভায় জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি এড. আজিজুর রহমান সভাপতিত্ব করেন। সভা পরিচালনা করেন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ইউসুফ আলী। বঙ্গবন্ধু বিকাল বেলা দিনাজপুর হতে ফুলবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন। বিকাল ৪টা হতে সাড়ে ৪টার দিকে আমবাড়ি পৌঁছালে স্থানীয় জনগণ তাকে বিপুলভাবে সংবর্ধিত করে। আমবাড়িতে তার সম্মানে এমন একটি তোরণ নির্মাণ করা হয় যার মাথায় ৬টি তারা (কাপড়ের তৈরী নক্ষত্র) ছিল। ছয়টি তারা ছয় দফার প্রতীক হিসেবে সাজানো হয়েছিল তোরণটিতে। এ কারণে তোরণের নাম পড়ে গিয়েছিল 'ছয় তারা গেট।' এখানে নাসরিন নামের একজন শিশুর দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে পুষ্প মালা দিয়ে বরণ করা হয়েছিল। নাসরিনের পিতার নাম মহসীন আলী, সাং- দৌলতপুর, আমবাড়ি। আমবাড়িতে জাতীয় তরুণ সংঘ নামে একটি ক্লাব ঘরে বক্তব্য রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। মাটির তৈরি ক্লাব ঘরটির ভেতরে কয়েক শত ও বাইরে কয়েক হাজার লোকের সমাগম ছিল। বঙ্গবন্ধু এখানে তার বক্তব্যে বলেন যে, যদি আগামীতে তার দল ক্ষমতায় আসে তাহলে জমির খাজনা ৩০ বিঘা পর্যন্ত মাফ করে দেয়া হবে। তিনি শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, আমাদের দেশে চিনি উৎপাদন হয়, সেই চিনি চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। তারা কম দামে চিনি খায়, আমাদেরকে বেশি দামে কিনতে হয়। এর জবাব ভোটের মাধ্যমেই জনগণকে দেয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি আমবাড়িতে এক ঘণ্টার বেশি সময় অবস্থান করেন। চা-নাস্তা খেয়ে পরে ফুলবাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন এবং সন্ধ্যার মধ্যে সেখানে পৌঁছে যান। ফুলবাড়ির কাটাপাড়ায় ডা. ওয়াকিলউদ্দিনের বাড়িতে ঘরোয়াভাবে কর্মিসভা করেন। কর্মিসভা শেষে দিনাজপুর ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগ নেতা এম আব্দুর রহিমের (পরে সংসদ সদস্য) মুন্সিপাড়ার বাড়িতে রাতের খাওয়া করেন। রাত যাপন করেন দিনাজপুর জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয়। পরদিন পঞ্চগড়ের উদ্দেশে রওনা দেন। সড়ক পথে যাওয়ার সময় পথে পথে জনতা বিপুলভাবে তাকে সংবর্ধিত করে। বাঁশেরহাট এলাকায় স্কুল ছাত্রীরা পুষ্প মাল্য দেয়ার জন্য অপেক্ষমাণ থাকলে বঙ্গবন্ধু সেখানে কয়েক মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে শিশুদের সাথে কথা বলেন। তৎকালিন ছাত্রনেতা (পরে সংসদ সদস্য) আমজাদ হোসেনের ছোট বোন জেসমিন আরা জ্যোস্না (পরে দিনাপুর সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান)সহ বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী বঙ্গবন্ধুর গলায় মালা পড়িয়ে দেয়। তিনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন।