সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
নারায়গঞ্জ জেলা
ক.ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য পর্যটন পণ্য : পর্যটন আকর্ষণ :
১. বিবি মরিয়মের সমাধি :
নারায়ণগঞ্জ শহরের হাজীগঞ্জ মহল্লায় অবস্থিত। মসজিদটি হাজীগঞ্জ মসজিদ নামেও পরিচিত। এটি বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান কর্তৃক নির্মিত। মসজিদের নিকটে একটি সৌধে সমাহিত তাঁর কণ্যা বিবি
মরিয়মের নামেই মসজিদের নামকরণ করা হযেছে। প্রাচীর বেষ্টিত একটি চতুষ্ক-প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে উঁচু ভিতের উপরে সৌধটি নির্মিত। সমাধিসৌধের চারপাশের বারান্দায় কয়েকটি সাধারণ কবর রয়েছে।
২. সোনাকান্দা দূর্গ :
শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বতীরে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দরে অবস্থিত একটি মুঘল জলদূর্গ। নদী পথে ঢাকার সাথে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ নদী পথগুলির নিরাপত্তা বিধানের জন্য মুঘলগণ কতগুলি জলদূর্গ নির্মাণ
করেছিলেন, সোনাকান্দা দূর্গ তার অন্যতম। এখানে একটি উচু মঞ্চ রয়েছে যেটি কামান স্থাপনের কাজে ব্যবহার করা হত। বিশাল আয়তনের মাটির ঢিবিসহকারে গঠিত দুর্গপ্রাচীর দ্বারা সুরক্ষিত।
৩. কবি বেনজির আহমেদ-এর জন্মস্থান :
নারায়ণগঞ্জ জেলার ধানুয়াগ্রাম কবি বেনজির আহমদের জন্ম স্থান। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে বেনজীর ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের রীতির অনুসারী। তবে, তাঁর রচনার মূল সূর ছিল মূসলিম জাতীয়তাবাদ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে কবিতা বন্দীর বাঁশী, বৈশাখী এবং প্রবন্ধ ইসলাম ও কম্যুনিজম প্রধান। ১৯৮৩ সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
৪. মুড়াপাড়া প্রাসাদ :
নারায়নগঞ্জ শহরের উত্তর পশ্চিমে মুড়াপাড়া সদরে মুড়াপাড়া প্রাসাদে এর অবস্থান। প্রাসাদটি দোতালা এবং এতে ৯৫ টি কারুকাজময় কোঠা রয়েছে। জনৈক বিজয় চন্দ্র বানার্জি ১৯০৯ সালে এ প্রাসাদটি নির্মাণ করেন।
খ. ধর্মীয় : পর্যটন আকর্ষণ :
১. ফতেহ শাহ মসজিদ :
নারায়ণগঞ্জ জেলার মোগরাপাড়া ইউনিয়নের নগর সাদিপুর গ্রামের দরগাহ কমপ্লেক্স-এর অভ্যন্তরে অবস্থিত। মসজিদটি জালালউদ্দীন ফতেহ শাহ-এর শাসনামলে ১৪৮৪ প্রথম নির্মাণ করা হয় এবং ১৭০০-০১
সালে মুঘল আমলে গম্বুজ ও ভল্টের দ্বারা সংস্কার ও পুননির্মাণ করা হয়। মসজিদের কার্ণিস সুলতানি রীতি ক্রমশ বাঁকানো, যদিও প্যারাপেট মুঘল রীতিতে অনুভূমিকভাবে তৈরী।
২. কদম রসুল :
কদম রসুল এমন এক ধরণের পবিত্র স্থান যেখানে মহানবীর পদচিহ্ন সংবলিত পাথর খন্ড সংরক্ষিত থাকে। বাংলাদেশে সুপরিচিত কদম রসুলটি নারায়ণগঞ্জের বিপরীতে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে নবীগঞ্জে
অবস্থিত। ঢাকার জমিদার গোলাম নবী ১৭৭৭-১৭৭৮ সালে পবিত্র সৌধটি নির্মাণ করেন। এক গম্বুজ বিশিষ্ট সৌধটির সামনে রয়েছে বারান্দা, মধ্যের প্রকোষ্ঠে রয়েছে পাথরটি। এটি একটি ধাতব পাত্রে গোলাপ জলে ডুবানো থাকে।
৩. বন্দরশাহী মসজিদ :
নারায়ণগঞ্জ জেলার কদম রসুল থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বন্দর পৌর এলাকায় বন্দরশাহী মসজিদ অবস্থিত। সুলতান জালালুদ্দিন ফতেহ শাহ এর পদস্থ কর্মচারী আল-মালিক আল-মুয়াজ্জম বাবা সালেহ
কর্তৃক ১৪৮২ সালে মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের গম্বুজের গোড়ার দিকে চারপাশ ঘিরে রয়েছে পদ্ম ফুল ও কলসের নকশা-বেষ্টনী। শীর্ষভাগ মেরলোন শোভিত একটি ড্রামের উপর গম্বুজটির স্থাপনা মুঘল আমলে মসজিদটির সংস্কারের একটি অংশ বলে মনে হয়।
৪. লাঙ্গল বন্ধ :
ঢাকা থেকে প্রায় ২০ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোল ঘেঁষে ব্রম্মপুত্রের পাড়ে অবস্থিত একটি জনপদ। প্রতিবছর চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে এই স্থানে ব্রম্মপুত্র নদে পুণ্য স্নানার্থে দেশ-
বিদেশের হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী ভক্ত প্রাণের আগমন ঘটে। ভক্তগণের বিশ্বাস এসময় ব্রম্মপুত্র নদে স্নান খুবই পুণ্যের। র্পূণাথীদের সুবিধার্তে অনেকগুলো ঘাট এবং মন্দির গড়ে উঠেছে।
৫. লোকনাথ বাবার আশ্রম :
লোকনাথ ব্রম্মচারী হিন্দু যোগী-সন্ন্যাসী। তিনি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে আফগানিস্তান, পারস্য, আরব, প্যালেস্টাইন, চীন, তিব্বত ইত্যাদি দেশ পরিভ্রমণ করেন এবং ১৮৬৩ সালে তিনি নারায়নগঞ্জের বারদী
গ্রামে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯০ সালে তিনি এই আশ্রমেই মৃত্যুবরণ করেন এবং তাঁর দেহবশেষ এখানেই সংরক্ষিত হয়। বর্তমানে এটি ভক্তজনের তীর্থক্ষেত্র রূপে পরিগণিত। প্রতিবছর দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর
ভক্ত এই তীর্থ ক্ষেত্র পরিদর্শনে আসেন।
৬. পঞ্চরত্ন মন্দির :
মুড়াপাড়া প্রাসাদের পেছনে শ্রীধর জিউর মন্দির নামে একটি পঞ্চরত্ন মন্দির আছে। এ মন্দিরের গায়ে শৈল্পিক নকশা এর বিশেষ আকর্ষন।
৭. হাজী বাবা সালেহ এর মাজার :
নারায়ণগঞ্জ জেলার কদম রসুল থেকে প্রায় এক মাইল দক্ষিণ-পূর্বে বন্দর পৌর এলাকায় অবস্থিত। আল-মালিক আল-মুয়াজ্জাম বাবা সালেহ ছিলেন সুলতান জালালুদ্দীন ফতেহ শাহ এর পদস্থ কর্মচারী ।
গ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক : পর্যটন আকর্ষণ :
১. তুলারাম কলেজ :
নারায়নগঞ্জ জেলা সদরে ১৯৩৭ সালে তুলারাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। তুলারাম ঐতিহ্যবাহী কলেজ। এখানে এইচএসসি, বিএ এর পাশাপশি কয়েকটি বিষয়ে অনার্সও করান হয়। উচ্চ শিক্ষায় কলেজটির ভূমিকা অগ্রগণ্য।
ঘ) নৌ-পর্যটন : পর্যটন আকর্ষণ :
১. শীতলক্ষ্যা নদীতে নৌ-বিহার :
শীতলক্ষ্যা নদী নারায়নগঞ্জের গর্ব। নদীটি নাব্য এবং সারা বছরই নৌ চলাচলের উপযোগী এবং এর ভাঙ্গন প্রবণতা কম। শীতলক্ষ্যা তার পানির স্বচ্ছতা এবং শীতলতার জন্য একদা বিখ্যাত ছিল। বছরের পাঁচ মাস
নদীটি জোয়ার-ভাটা দ্বারা প্রভাবিত থাকে, কিন্তু কখনোই কূল ছাপিয়ে যায় না। ফলে নদীতে প্রায় সারা বছরই নৌ-ভ্রমণ করা যায়।
সোনার গাঁ উপজেলা :
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য নিদর্শন : পর্যটন আকর্ষণ :
১. পানাম সিটি :
সোনারগাঁয়ের একটি প্রাচীন এলাকা। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত এলাকা ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে মোগরাপাড়া ক্রসিং থেকে প্রায় আড়াই কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে
সোনারগাঁয়ে হিন্দু আমলের রাজধানী শহরটি এখানেই অবস্থিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুরনো রাজধানী শহরের দক্ষিণে যে মুসলিম রাজধানী শহর গড়ে ওঠে, তারও অংশ ছিল এ পানাম এলাকা। পানাম নগরের ইমারতগুলি কোথাও পরস্পর বিচ্ছিন্ন, আবার কোথাও সন্নিহিত। এদের অধিকাংশই আয়তাকার এবং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত; উচ্চতায় এক তলা থেকে তিন তলা। ইউরোপীয় স্থাপত্যের অনুকরণে রূপায়িত হয়েছে ইমারতগুলির অলঙ্করণ সজ্জা। কোথাও কোথাও স্থানীয় নকশা ব্যবহৃত হয়েছে। পানাম নগরে ইমারতগুলি মসলিন ব্যবসায়ীদের আবাসস্থল।
২. পানাম সেতু :
সোনারগাঁয়ের অন্তর্গত হাবিবপুরের পূর্ব দিকে কোম্পানীগঞ্জ ও বারি-মজলিস গ্রামের মধ্যবর্তী পাকা রাস্তায় অবস্থিত। সেতুটি হাজীগঞ্জের সঙ্গে বৈদ্যের বাজারের সংযোগকারী কাঁচা সড়কে পঙ্খীরাজ খালের
উপর মুঘল আমলে (১৭শ শতক) নির্মিত হয়। তিন খিলানবিশিষ্ট এই সেতুর মধ্যবর্তী খিলানটি অপেক্ষাকৃত প্রশস্থ ও উঁচু।
৩. গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি :
বাংলার প্রথম ইলিয়াস শাহী বংশের তৃতীয় সুলতান গিয়াস উদ্দিন আজম শাহের সমাধি রয়েছে সোনারগাঁয়ে। গিয়াসউদ্দীন আজম শাহ তাঁর আদর্শ চরিত্র, শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা এবং সুশাসনের জন্য যথেষ্ট সুনাম
অর্জন করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দীন আজম শাহের সাথে পারস্যের বিখ্যাত কবি হাফিজের পত্রালাপ ছিল। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় শাহ মুহম্মদ সগীর তাঁর বিখ্যাত কাব্য ‘ইউসুফ জোলেখা রচনা করেন।
৪. বড় সর্দার বাড়ি :
সোনারগাঁয়ের ঈসাপুরে বড় সর্দার বাড়ি অবস্থিত। এখানে বাংলার বার ভূইয়ার অন্যতম ঈসা খাঁ’র শাসনামলের অনেক নিদর্শন রয়েছে। এখানে ঘোড়ার সওয়ার হিসেবে ঈসা খাঁ একটি মূর্তি রয়েছে। এই সর্দার বাড়িতেই বর্তমানে লোক শিল্প জাদুঘর গড়ে উঠেছে।
৫. খাসনগর দীঘি :
সোনারগাঁয়ে পানামের প্রায় এক মাইল দক্ষিণে খাসনগর গ্রামের সন্নিকটে অবস্থিত বিশাল দীঘি। কথিত আছে প্রায় বিশ একর জমির দীঘিটি বিস্তৃত ছিল। পরবর্তীকালে ১৮৭৯-৮০ সালের দিকে এর পরিমাপ ছিল ১২০০ ফুট ১৬০০ ফুট। দীঘির পাড়ে এক কালে বহুসংখ্যক তাঁতির আবাসস্থল ছিল। কথিত আছে, এ দীঘির পানিতে ধৌত মসলিন বস্ত্র অত্যুজ্জ্বল শুভ্রতা লাভ করত।
৬. রূপগঞ্জ রাজবাড়ি :
ঢাকা সিলেট মহাসড়কের মধ্যেখানেই রূপগঞ্জ। সেখানে আছে প্রায় শতবর্ষী রাজবাড়ি। অপূর্ব এই রাজবাড়ীর কারুকার্যমন্ডিত সৌন্দর্য দৃষ্টিনন্দন।
খ) ধর্মীয় : পর্যটন আকর্ষণ :
১. শাহ লঙ্গরের দরগাহ :
সোনারগাঁও এর মুয়াজ্জমপুর গ্রামে মুয়াজ্জমপুর শাহী মসজিদের চৌহদ্দি দেয়ালের অভ্যন্তরভাগে মসজিদের দক্ষিণ পার্শ্বে অবস্থিত। এই প্রাঙ্গণে একটি পুরাতন কূপ রয়েছে। প্রতিবছর অসংখ্য লোক ভক্ত দরগাহ
জেয়ারত করেন।
২. গোয়ালদি মসজিদ :
সোনারগাঁয়ে বিদ্যমান স্বল্পসংখ্যক মধ্যযুগীয় স্থাপত্য নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ১৭০৫ সালে আব্দুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি এটি নির্মাণ করেন। এটি একটি এক
গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। প্রাক-মুঘল যুগের ছোট্ট সুন্দর গোয়ালদি মসজিদটি এ এলাকার সর্ব প্রাচীন নিদর্শন।
গ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক : পর্যটন আকর্ষণ :
১. লোকশিল্প যাদুঘর :
পানাম শহর সংলগ্ন ঠাকুরবাড়ি ভবন ও ঈশা খাঁর তোরণকে কেন্দ্র করে ১৫.৬৬ হেক্টর জায়গা জুড়ে এর বিস্তৃত। এর অংশের অন্যতম আকর্ষণ ২টি জাদুঘর, ১টি লোকজ মঞ্চ, ১টি সেমিনার সেন্টার, ১টি কারুশিল্প
গ্রাম।
ঘ) উৎসব সম্পর্কিত : পর্যটন আকর্ষণ :
১. লোক ও কারুশিল্প মেলা :
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়জনে প্রতিবছর এর চত্বরে লোক ও কারুশিল্প মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশেষ করে যারা এ ফাউন্ডেশনের অধীনে রয়েছে তাদের তৈরী বিভিন্ন হস্তশিল্প দ্রব্যাদি এ মেলার প্রধান
উপকরণ।
২. লোক সংগীত মেলা :
লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের আয়োজনে সোনারগাঁয়ে প্রতিবছর লোকসংগীত মেলা অনুষ্ঠিত হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী, ভাওয়াইয়া, পল্লী, জারি-সারি, মুর্শিদী প্রভৃতি সঙ্গীত এখানে পরিবেশন করা হয়।
চ) প্রাকৃতিক : পর্যটন আকর্ষণ :
১. লিচু বাগান :
সোনারগাঁয়ের অন্যতম আকর্ষণ এখানকার লিচুবাগান। ঢাকা শহরের কাছাকাছি এরকম লিচু বাগান চোখে পড়েনা। বাগানে যখন লিচু ধরে তখন এর অপরূপ সৌন্দর্য দেশী-বিদেশী পর্যটকগণ উপভোগ করতে পারেন।