ঢাকা জেলা
ঢাকা মহানগরঃ
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য নিদর্শনঃ
পর্যটন আকর্ষণঃ
১. বঙ্গভবনঃ
বঙ্গভবন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের (রাষ্ট্রপতি) সরকারী বাসভবন। স্থাপনাটি দেশের রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত। প্রাসাদটি মূলত বৃটিশ ভাইসরয় অফ ইন্ডিযার অস্থায়ী বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত স্থাপনাটি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি ১২ তারিখে গভর্নর হাউসের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গভবন করা হয়। ঐ দিনই আবু সাইদ চৌধুরী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন এবং এ স্থানকে রাষ্ট্রপতির বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করেন। বঙ্গভবন বাংলাদেশ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি চিহ্ন, বঙ্গভবন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউস এবং ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনের সমমর্যাদা বহন করে। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে এর পরিচর্যা করা হয়, কারণ এটি একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা এবং এ সময় এটি জনসংযোগ মাধ্যমসমূহ ও পর্যটকদের মধ্যমনিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা দিবস এবং বিজয় দিবসে এখানে আমজনতার জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি এ ভবনে বসবাস এবং কাজ করে থাকেন, এবং এখানে প্রায়ই বিভিন্ন সভা, সম্মেলন এবং রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি এবং বৈদেশিক কুটনীতিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভোজের আয়োজন করা হয়।
২. গণভবনঃ
ঢাকার শের-ই-বাংলা নগরের বি-ব্লকের ৫ নং প্লটে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন যা গণভবন নামে পরিচতি। পূর্বে এর আয়তন ছিল ২২ একর। বর্তমানে মুল ভবনের আয়তন ১৫ একর। বিশ্ববিখ্যাত স্থাপতি মিঃ লুই কান এর থিউরি মতে উন্নতমানের সিরামিক ইটে নির্মান করা হয়েছে গণভবন। গণভবনের মুল ভবনের উপড় ও নীচতলা মিলিয়ে আয়তন ৩৭ হাজার বর্গ ফুট। মুল ভবনের সাথে বর্ধিতাংশ করে ব্যাংকোয়েট হল নির্মাণ কাজ শেষে গণভবনের মোট আয়তন বর্তমানে দাড়িয়েছে ৫৭ হাজার বর্গ ফুটে। দোতলা গণভবনের ওপর-নীচ তলায় রয়েছে বিশাল সাইজের ছয়টি রুম। উপড় তলায় আরো আছে বিলাশবহুল ৫টি স্যুইট এবং নীচ তলায় আছে ৬টি স্যুইট। উপরের তলায় অনেক বড় একটা রুমের নাম সেন্ট্রাল রুম এবং অন্য আর একটা রুমের নাম কনফারেন্স লাউঞ্জ। নীচ তলায় প্রধান মন্ত্রীর অফিস কক্ষ। রুমের ভিতরটা পূর্বে মোজাইক করা ছিল। বর্তমানে মোজাইক তুলে গ্রানাইট টাইলস বসানো হয়েছে। অফিস কক্ষের দুই পাশে দুটি করিডোর এবং লাউঞ্জ সম্পুর্ণ মার্বেল পাথরে গড়া। ভবনটিতে কিচেনরুম, ড্রইংরুম, স্টোররুম ছারাও আরো তিনটি রুম রয়েছে। ভবনের ভিতরে হেলিকপ্টার অবতরণের জন্য হেলিপ্যাড রয়েছে। এখানে ২ টি গোলাপ বাগান, ২ টি বারোয়ারী ফুলের বাগান, ফলজ বাগান ছাড়াও রয়েছে বিশাল লন। সেই লনেই বংগবন্ধু সকাল বিকাল পায়চারী করতেন। গণভবনের উত্তর প্রান্ত থেকে দক্ষিন প্রান্ত পর্যন্ত্য বিস্তৃত রয়েছে একটি মনোরম লেক। লেকের পশ্চিম দিকে রয়েছে শান বাধানো সুদৃশ্ব ঘাট। এই লেকে বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে মাছ চাষ করেছিলেন এবং ঐ ঘাটে বসেই মাছদের খাবার খেতে দিতেন। গণভবনের রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিন্টো রোডের প্রেসিডেন্ট হাউসে অফিস করতেন। প্রেসিডেন্ট হাউস তখোন গণভবন নামে পরিচিত ছিলো। প্রেসিডেন্ট হাউস বর্তমানে সুগন্ধা ভবন নামে পরিচিত। বর্তমানে সুগন্ধা ভবনে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস একাডেমী অফিস। স্বাধীনতার পর বৃটেনের রানী ২য় এলিজাবেথের প্রথমবার বাংলাদেশে আগমন উপলক্ষে ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তিনি এই ভবনে রাত যাপন করেছিলেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে বঙ্গবন্ধু অনেক কস্ট করে অফিস করতেন। সেখানে তার সকলস্টাফদের জন্য স্থান সংকুলান হতোনা। সেই অফিস ভবন ছোট হবার কারনেই বংবন্ধু ১৯৭৩ সনে শেরে বাংলা নগরে সংসদ ভবনের পাশে তাঁর বাসভবন ও সচিবালয় নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেন। গণভবন বঙ্গবন্ধুর সরকারী বাসভবন হলেও তিনি কখনো গণভবনে রাত যাপন করতেননা। তিনি থাকতেন তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে।
৩. আহসান মঞ্জিল (ইসলামপুর) :
আহসান মঞ্জিল পুরনো ঢাকার ইসলামপুরে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি পূর্বে ছিল ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ। বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব আবদুল গনি। তিনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহ’র নামানুসারে এর নামকরণ করেন। এর নির্মাণকাল ১৮৫৯-১৮৭২ সাল। ১৯০৬ সালে এখানে এক অনুষ্ঠিত বৈঠকে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়। আহসান মঞ্জিল কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। সর্বশেষ সংস্কার করা হয়েছে অতি সম্প্রতি। এখন এটি একটি জাদুঘর।অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে জালালপুর পরগনার জমিদার শেখ ইনায়েতউল্লাহ আহসান মঞ্জিলের বর্তমান স্থান রংমহল নামে একটি প্রমোদভবন তৈরি করেন। পরবর্তীতে তাঁর পুত্র রংমহলটি এক ফরাসি বণিকের নিকট বিক্রি করে দেন। বাণিজ্য কুটির হিসাবে এটি দীর্ঘদিন পরিচিত ছিল। এরপরে ১৮৩৫-এ বেগমবাজারে বসবাসকারী নওয়াব আবদুল গণির পিতা খাজা আলীমুল্লাহ এটি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেন। নওয়াব আবদুল গণি ১৮৭২ সালে প্রাসাদটি নতুন করে নির্মাণ করান। নতুন ভবন নির্মাণের পরে তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র খাজা আহসানউলল্লাহর নামানুসারে এর নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ১৮৯৭ সালে ১২ই জুন ঢাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানলে আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। আহসান মঞ্জিলের দক্ষিণের বারান্দাসহ ইসলামপুর রোড সংলগ্ন নহবত খানাটি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে। পরবর্তীকালে নবাব আহসানুল্লাহ তা পুনঃনির্মাণ করেন।এই প্রাসাদের ছাদের উপর সুন্দর একটি গম্বুজ আছে। এক সময় এই গম্বুজের চূড়াটি ছিল ঢাকা শহরের সর্বোচ্চ। মূল ভবনের বাইরে ত্রি-তোরণবিশিষ্ট প্রবেশদ্বারও দেখতে সুন্দর। একইভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িগুলোও সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে দু’টি মনোরম খিলান আছে যা সবচেয়ে সুন্দর। আহসান মঞ্জিলের অভ্যন্তরে দু’টি অংশ আছে। বৈঠকখানা ও পাঠাগার আছে পূর্ব অংশে। পশ্চিম অংশে আছে নাচঘর ও অন্যান্য আবাসিক কক্ষ। নিচতলার দরবারগৃহ ও ভোজন কক্ষ রয়েছে। আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে এখন পর্যন্ত সংগৃহীত নিদর্শন সংখ্যা ৪ হাজার ৭৭। এই রংমহলের ৩১টি কক্ষের মধ্যে ২৩টিতে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া ১৯০৪ সালের আলোকচিত্রশিল্পী ফ্রিৎজকাপের তোলা ছবি অনুযায়ী ৯টি কক্ষ সাজানো হয়েছে।গ্রীষ্মকালীন সময়সূচী: (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর)-(শনিবার-বুধবার) সকাল ১০.৩০ টা - বিকাল ৫.৩০ টা। শুক্রবার- বিকেল ৩.০০ টা – সন্ধ্যা ৭.৩০ টা। শীতকালীন সময়সূচী: (অক্টোবর - মার্চ) - (শনিবার-বুধবার) সকাল ৯.৩০ টা - বিকাল ৪.৩০ টা। শুক্রবার - দুপুর ২.৩০ টা - সন্ধ্যা ৭.৩০ টা। বৃহস্পতিবার - সাপ্তাহিক ছুটি ও অন্যান্য সরকারি ছুটির দিন জাদুঘর বন্ধ থাকবে।
৪. কার্জন হল :
বঙ্গভঙ্গ ঘোষিত হওয়ার পর প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য রমনায় ও অন্যান্য অঞ্চলে যেসব ইমারত নির্মাণ করা হয়েছিল কার্জন হল তার মধ্যে অন্যতম। ১৯০৪ সালে ভারতবর্ষের ভাইসরয় লর্ড কার্জন এই ইমারতটি নির্মাণ করেছিলেন। প্রাথমিকভাবে এটি একটি দৃষ্টিনন্দন টাউন হল হিসেবে স্থাপন করা হয় কিন্তু বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এখানে একটি কলেজ স্থাপন করা হয় যার নামকরণ হয় ‘ঢাকা কলেজ’ এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলে এর অধীনে চলে আসে। তখন থেকেই এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের ক্লাশ এবং পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
৫. বাহাদুর শাহ পার্ক :
পুরানো ঢাকার সদর ঘাটের সন্নিকটে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ্ পার্ক। এর পশ্চিমে সাবেক ষ্টেট ব্যাংক ভবন ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এবং উত্তর পশ্চিমে জেলা আদালত অবস্থিত। এর পূর্বনাম ছিল ভিক্টোরিয়া পার্ক। ১৯৬২ সনে স্থানটি সংস্কার সাধন করে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবে শহীদ বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে সিপাহী যুদ্ধের ঐক্যের প্রতীক শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ্ জাফরের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।
৬. লালবাগের কেল্লা :
লালবাগের কেল্লা মোগল আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন। মোগল আমলে বাংলায় নির্মিত ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত লালবাগের কেল্ল অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি। কেল্লার ভিতরে তিনটি পুরাকীর্তি রয়েছে। পরীবিবির মাজার, দরবার ঘর ও হাম্মামখানা এবং তিন গম্বুজওয়ালা মসজিদ। চারদিকে উঁচু প্রাচীনঘেরা এ কেল্লা দেখলে হঠাৎ মনে হয় লাল মাটির তৈরি। প্রাচীরের উচ্চতা কোথাও কোথাও বিশ ফুট পর্যন্ত। কেল্লায় ঢোকার জন্য চারটি ফটক ছিল। দক্ষিণ দিকের ফটকটি মূল ফটক হিসাবে ব্যবহার করা হতো। এখন এটি বন্ধ। ফটকের সামান্য উত্তরে একসময় গুপ্তপথ ছিল। কেউ কেউ মনে করেন, এ পথ দিয়ে গোপনে নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দা দুর্গের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হতো। গুপ্তপথটি এখন বন্ধ। নোংরা আবর্জনা জমে জায়গাটি এখন দর্শনার্থীদের যাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। দক্ষিণের ফটক থেকে উত্তরের ফটকে যাওয়ার মাঝ পথে রয়েছে চারকোণা একটি পুকুর। পুকুরের চারপাশের দেয়াল বাঁধানো। জনশ্রুতি আছে, সিপাহী বিপ্লবে নিহত এ অঞ্চলের সৈন্যদের লাশ এ পুকুরে ফেলা হতো। পুকুরের প্রায় দেড়’শ ফুট পশ্চিমে দরবার ঘর। এখানে সুবেদাররা দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করতেন। দরবার ঘরের নিচতলায় হাম্মামখানা। অনেকে মনে করে, এ ভবনে সুবেদার শায়েস্তা খান বাস করতেন। দরবার ঘর ও হাম্মামখানায় মুঘল স্থাপত্যের নিদর্শন রয়েছে। এখন এটিকে জাদুঘর হিসাবে সংরক্ষণ করা হচ্ছে।
পরীবিবির মাজারঃ
পরীবিবির পরিচয় নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তবুও বেশীরভাগ ঐতিহাসিকগন মনে করেন তিনি ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে শাহজাদা আজমের স্ত্রী। ঐতিহাসিকদের মতে, মাজার নির্মাণ করা হয়েছে ১৬৮৮ সালের আগে। দরবার ঘর থেকে প্রায় নব্বই গজ পশ্চিমে পরীবিবির মাজার। এটি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য একটি পুরাকীর্কি। হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্যের চমৎকার মিশ্রণ রয়েছে এতে। বলা হয়ে থাকে, সম্রাট হুমায়ুনের মাজারের অনুকরণে নির্মাণ করা হয়েছিল আগ্রার তাজমহল আর তাজমহলের অনুকরণে নির্মাণ করা হয়েছে পরীবিবির মাজার। পার্থক্য শুধু আয়তনে। মূল্যবান মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর, বিভিন্ন রঙের ফুল ও পাতার নকশা করা টালি দিয়ে মাজারের নয়টি ঘর সাজানো হয়েছে। ছাদ কষ্টিপাথরের তৈরি। সমাধির মাঝের ঘরের ওপর একটি গম্বুজ। বড় পাতের আচ্ছাদন দিয়ে তৈরি করা হয়েছে গম্বুজটি। মাজারের দিকে মোট বারোটি দরজা রয়েছে। পরীবিবির মাজারের প্রায় পঁয়তাল্লিশ গজ পশ্চিমে কেল্লার মসজিদ। মসজিদের চারকোণে চারটি মিনার এবং ছাদে তিনটি গম্বুজ রয়েছে।
ইতিহাস:
সতেরো শতকে বাংলায় মোগল শাসকদের শাসন মনভাব, স্থাপত্য বিকাশের ঐতিহাসিক ক্ষেত্র এই লালবাগ কেল্লা। ইতিহাসের পাতায় লালবাগ কেল্লার ররূপকার হিসেবে শায়েস্তা খানের নাম পাওয়া গেলও মুলত শায়েস্তা খান এর নিরমান কাজ শুরু করেন নি। এটি নির্মাণের স্বপ্ন এবং নির্মাণ শুরু হয়েছিল মোগল সম্রাট আওরাঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহের মাধ্যমে। আজম শাহ ১৬৭৮ থেকে ১৬৭৯ সাল পর্যন্ত বাংলার সুবেদার ছিলেন। এই সময় তিনি পিতার নামানুসারে একটি স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। যার প্রথম নাম আওরাঙ্গবাদ কিল্লা হলেও পরবর্তীতে নাম হয় লালবাগ কেল্লা। আজম শাহ কেল্লার কাজ শুরু করলে তিনি জরুরী তলবে ঢাকা ছেড়ে দিল্লি চলে যান। থেমে যায় কেল্লার নির্মাণ কাজ। আজম শাহ নতুন সুবেদার শায়েস্তা খান কে অনুরোধ করেন কেল্লার কাজটি সম্পূর্ণ করতে। কিন্তু শায়েস্তা খান এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে পারেন নি। অনেকের মতে বর্তমান এই লালবাগ কিল্লা নির্মাণের সময় শায়েস্তা খান তার কন্যা ইরান দুখত কে হারান, ইরান দুখত ছিলেন আজম খানের স্ত্রী এবং তিনিই ছিলেন কেল্লার প্রথম রুপকার। এর পর শায়েস্তা খান-এর বিশাস জাগে স্থানটি অপয়া। অতঃপর ১৬৮৪ সালে এর নির্মাণ বন্ধ করে দেন। কেল্লা নির্মাণ না করলেও তিনি তার কন্যার মাজার কে দর্শনীয় স্থাপনা বানিয়ে তুলেন। মাজারটি নির্মাণে শায়েস্তা খান ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে আসেন। সম্প্রতি এখানে লাইট এন্ড সাউন্ড সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, যা পর্যটকদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
৭. কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার :
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার্থে নির্মিত শহীদ মিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অবস্থিত। ভাষা সংগ্রামের প্রতীক এ শহীদ মিনারে প্রতিবছর আপাময় জনতা ২১ ফেব্রুয়ারী ফুলে ফুলে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ২১ তারিখের প্রথম প্রহরে (রাত ১২টা ১ মিনিটে) গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলদেশের মান্যবর রাষ্ট্রপতি এবং গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদনের মাধ্যমে শুরু হয় অমর ভাষা শহীদদের প্রতি সমগ্র জাতীর গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। বর্তমানে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসাবে সারাবিশ্বে পালন করা হচ্ছে। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। এর নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে। ১৯৫৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখে জনৈক মন্ত্রীর হাতে 'শহীদ মিনারের' ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কথা থাকলেও তাতে উপস্থিত জনতা প্রবল আপত্তি জানায় এবং ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ রিক্সাচালক আওয়ালের ৬ বছরের মেয়ে বসিরণকে দিয়ে এ স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান মহান ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত শহীদ মিনারের স্থপতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছেন। তাঁরই রূপকল্পনা অনুসারে নভেম্বর, ১৯৫৭ সালে তিনি ও নভেরা আহমেদের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সংশোধিত আকারে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ কাজ শুরু হয়। এ নকশায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সম্মুখভাগের বিস্তৃত এলাকা এর অন্তর্ভূক্ত ছিল। ১৯৬৩ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ ব্যক্তিত্ব আবুল বরকতের মাতা হাসিনা বেগম কর্তৃক নতুন শহীদ মিনারের উদ্বোধন করা হয়। ঢাকায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ হয়েছিল অতিদ্রুত এবং নিতান্ত অপরিকল্পিতভাবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২৩ ফেরুয়ারি বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শুরু করে রাত্রির মধ্যে তা সম্পন্ন করে। শহীদ মিনারের খবর কাগজে পাঠানো হয় ঐ দিনই। শহীদ বীরের স্মৃতিতে - এই শিরোনামে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ছাপা হয় শহীদ মিনারের খবর। মিনারটি তৈরি হয় মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেলের (ব্যারাক) বার নম্বর শেডের পূর্ব প্রান্তে। কোণাকুণিভাবে হোস্টেলের মধ্যবর্তী রাস্তার গা-ঘেঁষে। উদ্দেশ্য বাইরের রাস্তা থেকে যেন সহজেই চোখে পড়ে এবং যে কোনো শেড থেক বেরিয়ে এসে ভেতরের লম্বা টানা রাস্তাতে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে। শহীদ মিনারটি ছিল ১০ ফুট উচ্চ ও ৬ ফুট চওড়া। মিনার তৈরির তদারকিতে ছিলেন জিএস শরফুদ্দিন (ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন নামে পরিচিত), ডিজাইন করেছিলেন বদরুল আলম। সাথে ছিলেন সাঈদ হায়দার। তাদের সহযোগিতা করেন দুইজন রাজমিস্ত্রী। মেডিকেল কলেজের সম্প্রসারণের জন্য জমিয়ে রাখা ইট, বালি এবং পুরান ঢাকার পিয়ারু সর্দারের গুদাম থেকে সিমেন্ট আনা হয়। ভোর হবার পর একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় মিনারটি। ঐ দিনই অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে, ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদ শফিউরের পিতা অনানুষ্ঠানিকভাবে শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। উদ্বোধনের দিন অর্থাৎ ২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী মেডিকেলের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং প্রথম শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলে। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়।
৮. শাঁখারী বাজার :
শাঁখারীদের তৈরী শাঁখা ও শঙ্খের জন্য বিখ্যাত ছিল ঢাকা। ঢাকায় শাঁখারীদের আবাসিক এলাকা শাঁখারীবাজার এখনও বহন করেছে সেই ঐতিহ্য ও স্মৃতি। ১৬০৮ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দু সম্প্রদায় শাখা শিল্পসমেত শাঁখারী বাজারের গোড়াপত্তন করে। এখনো প্রায় ৭০-৮০ টি পরিবার শাখা শিল্পের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। শাখারী বাজারে রয়েছে প্রাচীন যুগের অনেকগুলো বাড়ি। শাঁখারী বাজার বাংলাদেশে সরকার ঘোষিত একটি হেরিটেইজ। এখানে বিদেশী পর্যটকগণ শাঁখারী বাজারের ঐতিহ্য দেখতে আসেন।
৯. নিমতলী কুঠি :
নিমতলি কুঠি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের নিমতলি এলাকায় অবস্থিত একটি মুঘল আমলের প্রাসাদ। এটি মুঘল আমালের শেষদিকে ১৭৬৬ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল। ঢাকার নায়েবে নাজিম (ডেপুটি গভর্ণর) জেসারত খানের জন্য নিমতলিতে এই প্রাসাদটি নির্মান করা হয়। পরবর্তীতে অন্যান্য নায়েবে নাজিমরাও এই প্রাসাদকে বাসভবন হিসাবে ব্যবহার করেছেন। নবাব গাজীউদ্দিনের মৃত্যুর পরে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধিগ্রহণ করে এবং এলাকার ভবনগুলো নিলামে বিক্রি করে দেয়। ক্রেতারা ভবনগুলির অধিকাংশই ভেঙে ফেলে। অবশিষ্ট অংশ পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার পুনরায় অধিগ্রহণ করে নেয়। বর্তমানে নিমতলি কুঠির কেবলমাত্র পশ্চিম ফটকটি টিকে আছে। এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বাংলাদেশের ভবনের প্রাঙ্গনে এটি রয়েছে।
১০. তাঁতী বাজার :
মুঘল আমলে প্রতিষ্ঠিত তাঁতীদের বাসস্থানের নামই তাঁতী বাজার। এস্থানে মোঘল আমলের অনেক স্থাপনা রয়েছে। বর্তমানে তাঁতী বাজার পুুরাতন ঢাকার অন্তর্গত একটি ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণের বাজার। প্রায় দেড় শতাব্দী আগে ব্রিটিশ শাসনামলে এই বাজারের গোড়াপত্তন হয়। বর্তমানে এখানে কয়েক হাজার স্বর্ণ ও বন্ধকী দোকান রয়েছে। তাঁতী বাজার মূলতঃ সোনা রূপার দোকানের জন্য বিখ্যাত। বাংলাদেশের অন্যতম জুয়েলারী মার্কেট হিসেবে তাঁতী বাজারের সুনাম রয়েছে। এই বাজারে প্রায় ১২০০ জুয়েলারী দোকান আছে। এখানে নিখুঁত ও বাহারী ডিজানের সোনা বা রুপার গহনা তৈরী করার জন্য প্রায় ৩০০০ কারখানা আছে। যেখানে প্রতি নিয়ত বাহারী নকশার বিপুল পরিমান গহনা তৈরী হয়। গহনার দোকান ও কারখানা ছাড়াও এখানে বেশ কিছু মুদি দোকান, ঔষধের ফার্মেসী, ষ্টেশনারী ও অন্যান্য দোকান রয়েছে। হিন্দু অধ্যুষিত তাঁতী বাজারে বাজার এলাকায় একটি মসজিদ ও দু’টি মন্দির আছে। এখানকার শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বর বাসুদেব মন্দির সেই ব্রিটিশ শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই মন্দিরটি ভেঙ্গে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আবার বাংলা ১৩৮১ সনে এই ঐতিহ্যবাহী শিব মন্দির পুনপ্রতিষ্ঠিা করা হয়।
১১.বাবু বাজার :
পুরান ঢাকায় অবস্থিত বাবুবাজারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। এ এলাকাটি ছিল জমিদার জগন্নাথ রায় বাবুর অধীন। এস্থানে জমিদার আমলের অনেক স্থাপনা রয়েছে। কালের বিবর্তনে এ স্থানের নাম জগন্নাথ বাবুর নামেই ‘বাবু বাজার’ হয়েছে।
১২. বাংলা বাজার :
বাংলা বাজার ঢাকার সবচেয়ে পুরান বনেদী এলাকা, যা মুঘল যুগের পূর্বেও ছিল। অনেকে মনে করেন সুলতানী আমলে যখন বাঙ্গালা শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছিল তখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বাংলা বাজার।
১৩. বিবি মরিয়ম কামান :
১৭ শতকের গোড়ারদিকে সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থাপন করলে রাজধানী ঢাকার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জোরদার করতে বেশ কিছু কামান তৈরি করা হয়। এসব কামানের মধ্যে “কালে খাঁ জমজম” ও “বিবি মরিয়ম” বিশালত্বে, নির্মাণশৈলীতে ও সৌন্দর্যে ভারতখ্যাত হয়ে ওঠে । কালে খাঁ বুড়িগঙ্গা নদীতে তলিয়ে গেলে বিবি মরিয়ম হয়ে ওঠে দর্শনীয় বস্তু। বিবি মরিয়মের দৈর্ঘ্য ১১ ফুট। মুখের ব্যাস ৬ ইঞ্চি। ঢাকার কামান তৈরীর কারিগর জনার্ধন কর্মকার অত্যন্ত শক্ত পেটানো লোহা দিযে কামানটি তৈরী করেন। সুবাদার মীর জুমলা ১৬৬১ সালে আসাম অভিযানের সময় ৬৭৫ টি কামান ব্যবহার করেন্ তার মধ্যে বিবি মরিয়ম ছিল সর্ববৃহৎ। যুদ্ধ বিজয়ের স্বারক হিসেবে তিনি বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার দক্ষিণে সোয়ারীঘাটে স্থাপন করেন। তখন কামানটি মীর জুমলার কামান নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৪০ সালে তৎকালীন ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ওয়ালটার্স ঢাকার চকবাজারে এটিকে স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৯২৫ সালে এটিকে সদরঘাটে স্থাপন করা হয়। গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে কামানটিকে সদরঘাট থেকে এনে শহরের শোভাবর্ধনের জন্য ঢাকার কেন্দ্র স্থল গুলিস্থানে স্থাপন করা হয়। ১৯৮৩ সালে এ কামানটিকে গুলিস্থানের মোড় থেকে উঠিয়ে এনে ওসমানী উদ্যানের প্রধান ফটকের পেছনে স্থাপন করা হয়।
১৪. হোসনী দালান :
হযরত ইমাম হোসেন (রা.)-এর কারবালার শোকাবহ ঘটনার স্মরণে নির্মিত অপরূপ স্মৃতিসৌধ হোসনী দালান ১৬৪২ সালে নির্মিত হয় ঢাকার নিমতলীর কাছে। এখানে রয়েছে হোসনী দালান, ইমামবাড়া, পুকুর মাকবারা-ই নায়ের নাজিম স্থানে ৮টি কবর, ইমাম হাসান (রা.) ও ইমাম হোসেন (রা.)-এর কবরের প্রতিকৃতি। হোসেনী দালান বা ইমামবাড়া একটি শিয়া উপাসনালয় এবং কবরস্থান। বিকল্প উচ্চারণ হুস্নী দালান এবং ইমারতের গায়ে শিলালিপিতে ফারসী ভাষায় লিখিত কবিতা অনুসারে উচ্চারণ হোসায়নি দালান। ইমারতটি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৌহিত্র হোসেন (রা:)-এর কারবালার প্রান্তরে শাহাদৎ বরণের স্মরণে নির্মিত। মোগল সম্রাট শাহজাহানের আমলে এটি নির্মিত হয়। এর নির্মাণকাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। ইমামবাড়ার দেয়ালের শিলালিপি থেকে জানা যায়, শাহ সুজার সুবেদারির সময় তাঁর এক নৌ-সেনাপতি মীর মুরাদ এটি হিজরী ১০৫২ সনে (১৬৪২ খ্রিস্টাব্দ) সৈয়দ মীর মোরাদ কর্তৃক নির্মিত হয়। তিনি প্রথমে তাজিয়া কোণা নির্মাণ করেন। ইমামবাড়া তারই পরিবর্ধিত আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর 'বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ' বইয়ে ভবনের দেয়ালে লাগানো শিলালিপির কথা উল্লেখ করেছেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা পরীক্ষার পর দেখেছেন ওই শিলালিপিটি নকল নয়। শিলালিপিতে উল্লেখ রয়েছে নির্মাতা হিসেবে মীর মুরাদের নাম। ঐতিহাসিক এম হাসান দানীও বলেছেন, 'মীর মুরাদই এখানে প্রথম ছোট আকারের একটি ইমামবাড়া স্থাপন করেছিলেন। পরে এটি ভেঙে যায় এবং নায়েবে-নাজিমরা নতুন করে তা নির্মাণ করেন।ইতিহাসবিদ জেমস টেলর তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেন, ১৮৩২ সালেও আদি ইমামবাড়া টিকে ছিল। ইস্ট-ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে দুই দফায় ইমামবাড়ার সংস্কার হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে ভবনটি প্রায় বিধ্বস্ত হয়। পরে খাজা আহসান উল্লাহ লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করে তা পুন:নির্মাণ ও সংস্কার করেন। ১৯৯৫-এ একবার এবং পরবর্তীতে ২০১১ তে পুনর্বার দক্ষিণের পুকুরটির সংস্কার করা হয়। ২০১১ খ্রিস্টাব্দে পুর্রহোসেনী দালান ইমামবাড়ার সংস্কারসাধন ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়।হোসেনী দালানের দক্ষিণাংশে রয়েছে একটি বর্গাকৃদির পুকুর। এর উত্তরাংশে শিয়া বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের কবরস্থান অবস্থিত। দালানটি সাদা বর্ণের, এবং এর বহিরাংশে নীল বর্ণের ক্যালিগ্রাফি বা লিপিচিত্রের কারূকাজ রয়েছে। একটি উঁচু মঞ্চের ওপর ভবনটি নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরেও সুদৃশ্য নকশা বিদ্যমান। ইরান সরকারের উদ্যাগে ২০১১ খ্রিস্টাব্দে হোসেনী দালানের ব্যাপক সংস্কার সাধন করা হয়। ইরান সরকার এতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদান করে। ইরানের স্থপতিবিদ ও শিল্পীরা এতে অংশগ্রহণ করেন। ফলে ইরানের ধর্মীয় স্থাপনার বাহ্যিক রূপ ও নান্দনিকতা এ সংস্কার কাজে প্রতিফলিত হয়েছে। সংস্কারের আগে ভেতরে রং-বেরঙের নকশা করা কাচের মাধ্যমে যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল, তা পরিবর্তন করে বিভিন্ন আয়াত ও মুদ্রা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। একইভাবে এর পূর্বদিকের ফটকে এবং উত্তর দিকের চৌকোনা থামগুলোয় আযাত ও সুরা লিখিত নীল রঙের টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলসগুলো ইরান থেকে আমদানি করা এবং এতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ইরানের ধর্মীয় শিল্পকলা ক্যালিগ্রাফি। ইরানের বেশ কিছু ধর্মীয় স্থাপনায় এ ধরনের টাইলস রয়েছে বলে জানা যায়।
১৫. পুরনো হাইকোর্ট ভবনঃ
রেনেসাঁ স্থাপত্যের অনুকরণে, বিশ শতকের গোড়ার দিকে ইংরেজ শাসক কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল এই ভবনটি। পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের গভর্নরের বাসভবন হিসেবে নির্মাণ করা হয়েছিল এ ভবনটি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর এখানে স্থাপনা করা হয়েছিল হাইকোর্ট।
১৬.পূর্ব বাঙ্গালা ব্রাক্ষন সমাজ মন্দির :
১৮৪৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর ঢাকার কুমারটুলীর গোলাম মিস্ত্রির বাড়িতে স্থাপিত হয়েছিল পূর্ব বাংলার প্রথম ব্রাম্মসমাজ। এ মন্দির থেকে ব্রাম্ম আন্দোলন শুরু হয়ে পরবর্তীতে তা পূর্ববঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছিল।
১৭.চক বাজার :
এটি মুঘল আমলে পুরান ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত একটি বাজার। মুঘল সেনাপতি মানসিংহ এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে মুঘল আমলের অনেক স্থাপত্য নিদর্শন এবং মুঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী খাবার-দাবারের সুনাম রয়েছে।
১৮. আরমানী টোলা :
মুঘল শাসনামলে ভাগ্য পরিবর্তনে আসা আর্মেনীয়রা এখানে এসে বাস করে বলে এ অঞ্চলের নাম আর্মেনীটোলা। এখানে আর্মেনীয়দের গীর্জাসহ কিছু স্থাপনা রয়েছে।
১৯. জাতীয় সংসদ ভবন :
ঢাকার শের-এ-বাংলা নগরে অবস্থিত প্রখ্যাত আমেরিকান স্থপতি লুই আই কান এর প্রস্তুতকৃত ডিজাইনে ২০৮ একর জমির উপর নির্মিত জাতীয় সংসদ ভবন এ উপমহাদেশের অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন। জাতীয় সংসদ ভবন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রধান ভবন। এটি ঢাকার শেরে-বাংলা নগর এলাকায় অবস্থিত। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত আটটি সংসদ নির্বাচনের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নির্বাচনের পর গঠিত সংসদের অধিবেশনগুলি অনুষ্ঠিত হয় পুরনো সংসদ ভবনে, যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তানের (বর্তমান পাকিস্তান) জন্য আইনসভার জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের নির্মাণ শুরু হয় ১৯৬১ সালে। ১৯৮২ সালের ২৮শে জানুয়ারি নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর একই বছরের ১৫ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদের অষ্টম (এবং শেষ) অধিবেশনে প্রথম সংসদ ভবন ব্যবহৃত হয়। তখন থেকেই আইন প্রণয়ন এবং সরকারি কর্মকান্ড পরিচালনার মূল কেন্দ্র হিসাবে এই ভবন ব্যবহার হয়ে আসছে। জাতীয় সংসদ ভবন জাতীয় সংসদ কমপ্লেক্সের একটি অংশ। কমপ্লেক্সের মধ্যে আরো আছে সুদৃশ্য বাগান, কৃত্রিম হ্রদ এবং সংসদ সদস্যদের আবাসস্থল। মূল ভবনটি (সংসদ ভবন) মূলতঃ তিন ভাগে বিভক্ত: মেইন প্লাজা : ৮২৩,০০০ বর্গফুট (৭৬,০০০ বর্গমিটার); সাউথ প্লাজা : ২২৩,০০০ বর্গফুট (২১,০০০ বর্গমিটার); প্রেসিডেন্সিয়াল প্লাজা: ৬৫,০০০ বর্গফুট (৬,০০০ বর্গমিটার)। মূল ভবনটি কমপ্লেক্সের কেন্দ্রে অবস্থিত। এমপি হোস্টেল এবং জরুরী কাজে ব্যবহৃত ভবনসমূহ কমপ্লেক্সের বহির্ভাগে অবস্থিত। মূল ভবন ঘিরে অবস্থিত কৃত্রিম হ্রদ, দুটি বাগান এর মাঝের শূণ্যস্থান পূরণ করেছে।মূল ভবনটি নয়টি পৃথক ব্লক দিয়ে তৈরী: মাঝের অষ্টভূজ ব্লকটির উচ্চতা ১৫৫ ফুট এবং বাকি আটটি ব্লকের উচ্চতা ১১০ ফুট। প্রতিটি ব্লকের জায়গাকে বিভিন্ন কাজের ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে, করিডোর, লিফট, সিড়ি ও বৃত্তাকার পথ দিয়ে আনুভূমিক ও উলম্বিকভাবে ব্লকগুলোর মাঝে আন্তঃসংযোগ স্থাপন করা হয়েছে। পুরো ভবনটির নকশা এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে সব ব্লকগুলোর সমন্বয়ে একটি ব্লকের অভিন্ন স্থান হিসাবে ব্যবহার করা যায়। মেইন প্লাজার মূল অংশটি হচ্ছে সংসদ অধিবেশন কক্ষ। এখানে একই সময়ে ৩৫৪ জন সদস্যের সংস্থান রাখা হয়েছে। ভিআইপিদের জন্য দুইটি পোডিয়াম এবং দুইটি গ্যালারী রয়েছে। পরাবৃত্তাকার ছাদসম্পন্ন অধিবেশন কক্ষটির উচ্চতা ১১৭ ফুট। ছাদটি স্বচ্ছভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে দিনের আলো এতে প্রবেশ করতে পারে। সূর্যের আলো চারদিকের ঘেরা দেয়াল ও অষ্টভূজকৃতির ড্রামে প্রতিফলিত হয়ে অধিবেশন কক্ষ প্রবেশ করে। (আলোর নান্দনিকতা ও সর্বোচ্চ ব্যবহার লুই কানের স্থাপত্য ক্ষমতার নিদর্শনস্বরূপ) কৃত্রিম আলোকে এমনভাবে বিভক্ত করা হয়েছে যে সূর্যের আলোর প্রবেশের ক্ষেত্রে তা কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারে না। শ্যান্ডেলির বা ঝাড়বাতিগুলো পরাবৃত্তাকার ছাদ হতে নিচে নেমে এসেছে। এর গঠনশৈলীতে ধাতুর ব্যবহার প্রতিটি আলোক উৎসর ভিত্তি হিসাবে কাজ করে।দ্বিতীয় তলার একটি লাগোয়া ব্লকে প্রধান কমিটির রুমগুলো রয়েছে। সকল ধরনের সংসদীয় কার্যক্রম, মন্ত্রী, চেয়ারপারসন এবং স্ট্যান্ডিং কমিটির অফিস রয়েছে এই ভবনে। একই ভবনে সংসদীয় সচিবের জন্যও কিছু অফিস বরাদ্দ রয়েছে।এই স্থাপনার স্থাপত্য দর্শনের মূলে ছিল স্থানের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলা। প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে স্থাপত্যশৈলী দ্বারা।
২০. তিন নেতার সমাধিঃ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের সন্নিকটে দোয়েল-চত্বরের কাছে অবস্থিত তিন নেতার সমাধি। ঐতিহাসিক হাজী শাহবাজ মসজিদের (১৬৭৯) পাশেই স্থাপিত এটি 'জাতীয় তিন নেতার সমাধিসৌধ। জাতীয় এ তিন নেতারা হলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক (জন্ম ১৮৭৩-মৃত্যু ১৯৬২), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (জন্ম ১৮৯২-মৃত্যু ১৯৬৩) ও সাবেক পূর্ববঙ্গের (র্বতমান বাংলাদেশ) মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমদ্দুীন (জন্ম ১৮৯৪-মৃত্যু ১৯৬৪) এ তিন নেতা চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এ মাজারে। দক্ষিণে আছেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাঝে খাজা নাজিমদ্দুীন ও উত্তরে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের সমাধি। চমৎকার দৃষ্টিনন্দন এই সমাধিসেনধের স্থপতি মাসদু আহমেদ। গণপূর্ত অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে আশির দশকের মাঝামাঝিতে নির্মিত হয় স্থাপনাটি। ১৯৭৯ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হলেও শেষ হয় ১৯৮৫ সালে। তিনটি উঁচু কলাম দ্বারা নির্মিত এ সমাধিসেনধের ভেতরে প্রবেশের জন্য দুটি সুড়ঙ্গের মতো পথ রয়েছে। ভেতরে তিন নেতার কবরস্থান এবং বেদির ওপর কবরের মডেল; তার ওপর সমাধিসেনধ। তিন নেতার মাজারটি গণপূর্ত অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। তিন নেতার জন্মবার্ষিকী এবং মৃত্যুবার্ষিকীতে ধোয়া-মোছা ও পরিষ্কারের কাজ হয় এবং বিশেষ দিনগুলোতে মাজারে প্রবেশের জন্য খুলে দেয়া হয়।
২১. বড় কাটরাঃ
মুঘল রাজধানী ঢাকার চকবাজারের দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থিত। মধ্য এশিয়ার ক্যারাভান সরাই-এর ঐতিহ্য অনুসরণে নির্মিত বড় কাটরা দারুণভাবে সুরক্ষিত এবং মুঘল রাজকীয় স্থাপত্য-রীতির বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। ভবনটি ১৬৪৩-১৬৪৫ সালের ভিতর নির্মিত হয়। বড় কাটরা পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে এখনো সুপরিচিত। মুঘল আমলে এটি নায়েবে নাজিমদের বাসস্থান তথা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হত।
২২. ছোট কাটরাঃ
ছোট কাটরা শায়েস্তা খানের আমলে তৈরি একটি ইমারত। আনুমানিক ১৬৬৩ - ১৬৬৪ সালের দিকে এ ইমারতটির নির্মান কাজ শুরু হয় এবং তা ১৬৭১ সালে শেষ হয়েছিল। এটির অবস্থান ছিল বড় কাটারার পূর্বদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। ইমারতটি দেখতে অনেকটা বড় কাটারার মত হলেও এটি আকৃতিতে বড় কাটারার চেয়ে ছোট এবং এ কারণেই হয়তো এর নাম হয়েছিল ছোট কাটারা। তবে ইংরেজ আমলে এতে বেশ কিছু সংযোজন করা হয়েছিল। শায়েস্তা খানের আমলে ছোট কাটরা নির্মিত হয়েছিল সরাইখানা বা প্রশাসনিক কাজে ব্যবহারের জন্য। কোম্পানি আমলে ১৮১৬ সালে মিশনারি লিওনারদ ছোট কাটরায় খুলেছিলেন ঢাকার প্রথম ইংরাজি স্কুল। ১৮৫৭ সালে, এখানে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকার প্রথম নরমাল স্কুল। উনিশ শতকের শেষ দিকে অথবা বিশ শতকের প্রথম দিকে ছোট কাটরা ছিল নবাব পরিবারের দখলে। এবং তাতে তখন কয়লা ও চুণার কারখানার কাজ' চলত। বর্তমানে, ছোট কাটরাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এখনও এর ধ্বংসাবশেষ দেখলে বোঝা যায় মোঘল আমলে নদীতীরে দাঁড়িয়ে থাকা কাটরাকে কী সুন্দরই না দেখাত!
২৩. রূপলাল হাউজঃ
অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে নির্মিত পুরান ঢাকায় অবস্থিত একটি মনোরম ও বৃহৎ অট্টালিকা। ধারনা করা হয় ঢাকার একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শ্রী রুপলাল দাস তার পরিবার সহ বসবাসের জন্য ইমারতের নকশা তৈরী করেন। পরবর্তীতে তিনি এই অভিজাত ও রাজকীয় রুপলাল হাউজ নির্মাণ করেছিলেন। অতঃপর তার উত্তরাধিকারীদের প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে এ ইমারত ধীরে ধীরে রুপলাল হাউজের সম্প্রসারণের কাজ করতে থাকে। রূপলাল হাউস ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত রেনেসাঁ যুগের ইউরোপীয় স্থাপত্যের একটি চমৎকার উদাহরণ। গ্রীক স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত এর বিশাল ডরিক কলাম, যা ঢাকা শহরের আর কোথাও দেখা যায়না। ভবনটির গৌরবময় দিনগুলিতে রুচি ও চমৎকারিত্বের দিক দিয়ে এটি আহসান মঞ্জিলের সঙ্গে পাল্লা দিত। পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বি পরিকল্পিত এ ইমারতের সর্ব পশ্চিমাংশ উত্তর দিকে উদগত। এ উদগত অংশের সামনের দিকে একটি বারান্দা আছে। ফ্যাসাদে আছে ছয়টি করনিথীয় থামের একটি সারি। এদের ধড় শীরতোলা। অনুরুপ কার্নিস থামের আছে একটি বিরাট আকারের পডিয়াম। বারান্দা ব্যতীত ইমারতটির অপরটি দ্বিতল। মধ্যবর্তী অংশ দিয়ে ইমারতের বিপরীত দিকে যাতায়াতের জন্য আছে একটি উম্মুক্ত অংশ। এ ফটকের অনতিদূরে পূর্বদিকে সম আকৃতির আরও একটি বারান্দা দেখা যায়। এ ইমারতের পূর্বাংশের প্রান্ত থেকে উদগত অংশ উত্তর দিকে অগ্রসর হয়েছে। তবে এ অংশ মূল নির্মাণ যুগের পরবর্তীকালের বলে অনুমান করা যায়। সমতল ছাদের কয়েকটি ছাদের কয়েকটি স্থানে তিনটি চিলেকোঠা আছে। এর দরজা ও জানালাগুলোতে কাঠের ভেনেসীয় গ্রিল সম্বিিলত পাল্লা ব্যবহৃত হয়েছে। সিঁড়ির বেড়িতে লোহার অলঙ্করণ খচিত ফ্রেম আছে। খিলানের টিমপেনামে রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করনও লক্ষ্য করা যায়। ১৮৮৮ সালে ভারতের ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের ঢাকা সফরকালে তাঁর সম্মানে স্থানীয় ইংরেজরা রূপলাল হাউসে বল নাচের আয়োজন করে। ঢাকা শহরের সূত্রাপুর থানাধীন ৭৯ নং ওয়ার্ডের শ্যামবাজার এলাকার মোড়ের ৭০ গজ উত্তর দিকে হাতের বাম পাশে ১২ নং ফরাশগঞ্জে এই রুপলাল হাউজের অবস্থান।
২৪. রমনা রেসকোর্স/সোহরাওয়ার্দী উদ্যানঃ
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম ছিল 'রমনা জিমখানা'। সে সময় রমনায় ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি সামরিক ক্লাব। তারপর ১৬১০ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সুবেদার ইসলাম খান রাজধানী প্রতিষ্ঠা করে ঢাকা উত্তর শহরতলিতে দুটি চমৎকার আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করেন। একটি তার ভাইয়ের নামে 'মহলা চিশতিয়া' এবং অন্যটি তার সেনাধ্যক্ষ সুজা খানের নামানুসারে 'মহলা সুজাতপুর' এলাকার নামকরণ করেন। মুঘল সাম্রাজের পতনের পর রমনা ধীরে ধীরে তার পুরনো গৌরব হারিয়ে ফেলে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে রমনা ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত এলাকা। ১৮২৫ সালে ঢাকার ব্রিটিশ কালেক্টর মি. ডয়েস ঢাকার উন্নয়নকল্পে কয়েকটি বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি পুরো রমনা এলাকা পরিষ্কার করে নাম দেন রমনা গ্রিন। তারপর রমনাকে রেসকোর্স হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঠের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেন। প্রতি রোববার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো বৈধভাবে ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতা। তখন থেকেই ঢাকা আবার তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে শুরু করে। নাজির হোসেন 'কিংবদন্তির ঢাকা' গ্রন্থে লিখেছেন, 'ব্রিটিশ আমলে রমনা ময়দানটি ঘোড় দৌড়ের জন্য বিখ্যাত ছিল। প্রতি রোববার হতো ঘোড়দৌড়। এটা ছিল একই সঙ্গে ব্রিটিশ শাসক ও সর্বস্তরের মানুষের চিত্তবিনোদনের একটি স্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. শরীফ উদ্দিন আহমেদের এক বিবরণ থেকে জানা যায়, চার্লস ডজ রমনায় রেসকোর্স বা ঘোড়া দৌড়ের মাঠ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকার খ্যাতনামা আলেম মুফতি দীন মহম্মদ এক মাহফিল থেকে ঘোড়দৌড়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। সে কারণে সরকার ১৯৪৯ সালে ঘোড়দৌড় বন্ধ করে দেয়। ঢাকার নবাবদের আনুকূল্যে একসময় ঘোড়দৌড় খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্রাবাস মহসীন হলের উত্তরপাশে নবাবদের ঘোড়ার আস্তাবল কিছুদিন আগেও অক্ষত ছিল। ঢাকার নবাবরা রেসকোর্স এলাকাটি উনয়্নন করেন। তৈরি করেন একটি সুন্দর বাগান। তার নাম দেন শাহবাগ বা রাজকীয় বাগান। নবাবরা রমনা রেসকোর্সে একটি চিড়িয়াখানাও স্থাপন করেছিলেন। ১৮৫১ সালে রেসকোর্সের উত্তর কোণে ব্রিটিশ আমলারা ঢাকা ক্লাব স্থাপন করেন। পরে ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের শাসনামলে বঙ্গভঙ্গের সময় পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে নবগঠিত প্রদেশের গভর্নরের সরকারি বাসভবন স্থাপনের জন্যও রমনা এলাকাকে নির্বাচন করা হয়। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্তি পেলে রমনা রেসকোর্সে তাকে এক নাগরিক সংবর্ধনা এবং তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে এক মহাসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণে দেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এ ময়দানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে পাকিস্তানি সৈন্যরা আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বক্তব্য রাখেন। সে সময় থেকে রমনা রেসকোর্স গুরুত্বপূর্ণ ও রাজনৈতিক সমাবেশের স্থানে পরিণত হয়। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর জাতীয় নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামানুসারে রমনা রেসকোর্স ময়দানের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'সোহরাওয়ার্দী উদ্যান' । সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা-সংক্রান্ত যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৯৯ সালে স্বাধীনতা স্মৃতিস্তম্ব এবং শিখা চিরন্তন স্থাপন করা হয়।
২৫. বধ্যভূমি স্মৃতি সৌধঃ
মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের উষালগ্নে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার আলবদর বাহিনীর বাঙালি-বুদ্ধিজীবী নিধনের স্থান ছিল রায়েবাজার বধ্যভূমি। যেখানে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বাঙালি জাতির বিবেক, চেতনা, মননশীলতা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক- এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান- বুদ্ধিজীবীদের। পরিত্যক্ত ইটের ভাটার এ বধ্যভূমি থেকে আজো ভেসে আসে শৃংখলিত হাত পা, উৎপাটিত চোখ, বেয়নেটবিদ্ধ শহীদের আর্তনাদ; শোনা যায় স্বাধিকার প্রত্যাশী প্রতিবাদী কণ্ঠের গোঙানি আর মানুষরূপী রক্তলোলুপ হায়েনার মারণ-উল্লাস।
রায়েরবাজার বধ্যভূমিটি বৃত্তচাপের আকারে এক প্রাচীর খ-। তিন ফুট পুরু ৩৮০ ফুট লম্বা দেয়ালটির এক প্রান্ত যেন মাটি ভেদ করে উঠে এসেছে ৫৮ ফুট উচ্চতায়। জ্যামিতিক শুদ্ধতায় বাঁকা দেয়ালটির অপর প্রান্ত একইভাবে হারিয়ে গেছে মাটিতেই। এর চওড়া অংশে বিশ ফুট বর্গাকার একটি জানালা। একটা বেশ বড় কালো পাথরের স্তম্ভ এবং এর সামনেই উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। এ সৌধ কেবলই কোনো স্মৃতিসৌধ নয়, মহাকালের নৃশংসতম হত্যাকা-ের ভয়াবহ স্মৃতি। পরিত্যক্ত ইটের ভাটায় স্থাপিত বধ্যভূমি থেকে আজও যেন শোনা যায় শহীদের আর্তনাদ। স্মৃতিসৌধের প্রতিটি ইট, বালু, মাটি, পানি, গাছ আজও কাঁদে জাতিকে কাঁদায়। এ শোকানুভূতির বিমূর্ত প্রতিফলন ও বিনির্মাণবাদের ধারায় নির্মিতব্য এক বেদনাপ্লুত স্থাপত্যকর্ম রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ এলাকায় বাঁ দিকের প্রধান গেট দিয়ে ঢুকতেই পাশে দেয়ালের গায় উপরের এই হৃদয়-নিংড়ানো লেখাগুলো সহজেই চোখে পড়বে সবার। স্থপতি মোঃ জামী আল-সাফী ও স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ-এর প্রণীত স্থাপত্য-নক্সা অনুযায়ী গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রনালয়ের গণপূর্ত অধিদপ্তরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত এই রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিসৌধটির বিশাল ব্যাপ্তি নিয়ে ভিন্নমাত্রিক নির্মাণশৈলী এক অন্যরকম মনোবিক্ষেপ তৈরি করে দেয়। এক ভাবগম্ভীর শোক-বিহ্বলতা ছড়িয়ে আছে সবখানে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে ১৯৭১ সালের ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করে এখানে ফেলে রাখা হয়। দখলদার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে এবং বাঙালির বুকে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগানোর পেছনে বুদ্ধিজীবীদের অনুপ্রেরণা রয়েছে- এমন ভেবেই তখন তাদের হত্যা করে। আর জাতিকে মেধাশূন্য করতে এ হত্যায় দখলদার বাহিনী সহায়তা নেয় তাদেরই এদেশীয় দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের। বুদ্ধিজীবীদের স্মরণেই আধুনিক স্থাপত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন হিসেবে এ স্মৃতিসৌধটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ১৯৯৬ সালে। ৬ দশমিক ৫১ একর জমির ওপর এ সৌধটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৯৯৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর। সৌধটির প্রধান অংশটি হলো বক্রাকৃতির দেয়াল। দেয়ালটির বক্রাকৃতি অংশের দৈর্ঘ্য ৩৮০ ফুট, আর সোজা অংশের দৈর্ঘ্য ৩৩০ ফুট। উচ্চতা ৫৬ ফুট। দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট। এখানে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার শোক বা বিষন্নতার আবহ সৃষ্টির জন্য দেয়ালের দু’পাশের কিছু অংশ ভেঙে রাখা হয়েছে। দেয়ালটির মাঝে ২০ ফুট বাই ২০ ফুটের একটি ফাঁকা অংশ বা ছিদ্র রয়েছে, যা দিয়ে সৌধের পেছনের প্রতিকৃতি বা আকাশ নানা বর্ণে ধরা দেয় দর্শনার্থীর কাছে। প্রতীকিভাবে চিন্তা করলে দর্শনার্থী যেন ফিরে যায় সেই একাত্তরে, ঘৃণা জানায় বর্বরোচিত সেই হত্যাকান্ডের। বক্র দেয়ালের সামনেই ১৬ হাজার ৬০০ বর্গফুটের একটি কৃত্রিম জলাশয় রয়েছে। এ জলাশয় থেকেই উঠে এসেছে ৩৩ ফুট উঁচু একটি কালো স্তম্ভ, যা এখানে আসা দর্শনার্থীদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তরের সেই কালো রাতগুলোতে।
২৬. শহীদ বুদ্ধিজীবি গোরস্থানঃ
মিরপুর এলাকায় গাবতলী মাজার সড়কের পশ্চিমে অবস্থিত। শহীদদের স্মরণে তিনটি থামের সমন্বয়ে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। চারদিকে বাগান রয়েছে। বাগানে ভিতরে পায়ে চলা পথ ও বসার ব্যবস্থা রয়েছে। একাত্তরের রাজাকাররা অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের তালিকা প্রণয়ন করে পাকিস্তানি সেনাপতি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলির কাছে দিয়েছিল। সেই তালিকা অনুযায়ী আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে দেশের মাথা, সেরা বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের গোপন আবাস থেকে চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে প্রথমে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আলবদর ঘাঁটিতে স্থাপিত ‘টর্চার সেন্টারে’ নির্মম দৈহিক নির্যাতনের পর ও মিরপুর গোরস্থানে ও রায়েরবাজার বধ্যভূমি নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ থেকে ২৭ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে নিহত হয়েছিলেন দর্শন বিভাগের গোবিন্দ চন্দ্র দেব, পরিসংখ্যান বিভাগের এ এন মুনিরুজ্জামান, ইংরেজি বিভাগের জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের ফজলুর রহমান, গণিত বিভাগের শরাফত আলী, ভূতত্ত্ব বিভাগের আবদুল মুকতাদির, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এ আর খান খাদিম ও ফলিত পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য। আরও নিহত হন বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষক মোহাম্মদ সাদেক। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মুনিরুজ্জামান ও অধ্যাপক ফজলুর রহমান পরিবার-পরিজন নিয়ে এবং অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব তাঁর পালিত কন্যা রোকেয়ার স্বামীসহ নিহত হযয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে ১০ থেকে ১৪ ডিসেম্বর আলবদর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষককে তাদের পরিবর্তিত বা গোপন আবাস থেকে খুঁজে খুঁজে বের করে তুলে নিয়ে মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে স্থাপিত আলবদর ঘাঁটিতে নির্যাতনের পর রায়েরবাজার মধ্যভূমি ও মিরপুর গোরস্থানে নিয়ে হত্যা করে। তাদের মধ্যে ছিলেন বাংলা বিভাগের মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ও আনোয়ার পাশা; ইতিহাস বিভাগের সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য ও আবুল খায়ের ও গিয়াসউদ্দিন আহমেদ; ইংরেজি বিভাগের রাশীদুল হাসান এবং শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিরাজুল হক খান, ফয়জুল মহী ও শাহাদত আলী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক মোহাম্মদ মোর্তজাকেও তারা হত্যা করে। আলবদর বাহিনী শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই যুদ্ধ, ব্ল্যাক আউট ও কারফিউর মধ্যে ইপিআরটিসির একটা মাটিলেপা বাসে করে তুলে নিয়ে যায়নি; আরও অনেক সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলীকে ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করেছিল। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা, সাংবাদিক শহীদ সাবের, সুরকার আলতাফ মাহমুদ, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেন, শহীদুল্লা কায়সার, সৈয়দ নজমুল হক, নিজামুদ্দীন আহমেদ, আ ন ম গোলাম মোস্তফা, সাংবাদিক সেলিনা পারভীন, বিজ্ঞানী আবুল কালাম আজাদ, সিদ্দিক আহমদ, আমিনউদ্দিন, চিকিৎসক ডা. ফজলে রাব্বী ও ডা. আলীম চৌধুরী। মেহেরুন্নেসা ও শহীদ সাবেরকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপর পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। অমর সুরকার আলতাফ মাহমুদকে ধরে নিয় অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে রায়রবাজার বধ্যভূমিতে যাদের হত্যা করা হয়, তাদের অনেকের অঙ্গহীন লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যাদের মিরপুর গোরস্থানে হত্যা করে ধানখেতে গণকবরে পুঁতে রাখা হয়েছিল, তাদের দেহ শনাক্ত এবং বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
২৭. জিনজিরা প্রাসাদঃ
সোয়ারীঘাট সংলগ্ন বড় কাটরা প্রাসাদ বরাবর বুড়িগঙ্গার ওপারে জিনজিরা। জিনজিরা-জাজিরার অপভ্রংশ, যার অর্থ আইল্যান্ড বা দ্বীপ। এ দ্বীপে ১৬২০-২১ খ্রিস্টাব্দে জিনজিরা প্রাসাদ ‘নওঘরা’ নির্মাণ করেছিলেন তৎকালীন সুবেদার নওয়াব ইব্রাহিম খাঁ। আজ থেকে প্রায় ৪০০ বছর আগে শহর থেকে জিনজিরার মধ্যে চলাচলের জন্য একটি কাঠের পুল ছিল। কয়েক একর জমির ওপর এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল অবকাশ যাপন ও চিত্তবিনোদনের প্রান্তনিবাস হিসেবে। চার দিকে সুনীল জলরাশির মাঝখানে একখ- দ্বীপ ভূমি জিনজিরা। নারিকেল-সুপারি, আম-কাঁঠালসহ দেশীয় গাছগাছালির সবুজের সমারোহে ফুলে ফুলে শোভিত অপূর্ব কারুকার্যখচিত মোগল স্থাপত্যশৈলীর অনুপম নিদর্শন জিনজিরা প্রাসাদ। স্থানীয়দের মতে মোগল আমলে লালবাগ দুর্গের সঙ্গে জিঞ্জিরা প্রাসাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার জন্য বুড়িগঙ্গার তলদেশ দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ পথ তৈরি করা হয়েছিল। এপথে মোগল সেনাপতি ও কর্মকর্তারা আসা-যাওয়া করত। লালবাগ দুর্গেও এমন একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বলা হয়ে থাকে এই সুড়ঙ্গ পথে যে একবার যায় সে আর ফিরে আসে না। তবে ইতিহাসে এ সম্পর্কে জোরালোভাবে কিছু বলা নেই। এ প্রাসাদটির নির্মাণশৈলী বড়কাটরার আদলে হলেও কক্ষ ও আয়তন অনেক কম। পশ্চিমাংশে দু’টি সমান্তরাল গম্বুজ, মাঝ বরাবর ঢাকনাবিহীন অন্য একটি গম্বুজ ও পূর্বাংশ দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে পুরো প্রাসাদের ছাদ। প্রাসাদের পূর্বাংশে ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। এ প্রাসাদের তিনটি বিশেষ অংশ আজো আংশিক টিকে আছে তাহলো - প্রবেশ তোরণ, পৃথক দু’টি স্থানে দু’টি পৃথক প্রাসাদ, একটি দেখতে ফাঁসির মঞ্চ ও অজ্ঞাত অন্যটি প্রমোদাগার। প্রাসাদটির পূর্বাংশ তিনতলা সমান, দেখতে অনেকটা ফাঁসির মঞ্চ বা সিঁড়িঘর বলে মনে হয়। মাঝ বরাবর প্রকা- প্রাসাদ তোরণ। মোগল স্থাপত্যের অপূর্ব কারুকার্যখচিত তোরণ প্রাসাদকে দুই ভাগ করে অপর প্রান্তে খোলা চত্বরে মিশেছে। প্রাসাদ তোরণের পূর্বাংশেই ছিল সুড়ঙ্গপথ। ব্রিটিশ-পাকিস্তান আমল থেকে দেখে এলেও অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কেউ ঢুকতে সাহস করত না এই সুড়ং পথে।পলাশীর যুদ্ধে সর্বস্বান্ত সিরাজদ্দৌলার পরিবার পরিজনকে জরাজীর্ণ জিনজিরা প্রাসাদে প্রেরণ করা হয়েছিল। আর সেই সাথে নবাব আলিবর্দী খাঁর দুই কন্যা ঘসেটি বেগম ও আমেনা বেগমকেও আনা হয়। তারা দু’জনই পিতার রাজত্বকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। অবশেষে এক দিন পরিচারিকাদের সাথে একই নৌকায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। সে দিন বুড়িগঙ্গার তীরের জিনজিরা প্রাসাদে বন্দীদের নিয়ে রক্ষীদল উপস্থিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, নবাব আলিবর্দী খাঁ ও তার পরিবার আগেই এখানে স্থান লাভ করেছিল। এভাবে পরাজিত নবাবের পরিবার-পরিজন জিনজিরা প্রাসাদে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তারপর মীরজাফরের পুত্র মীরনের চক্রান্তে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের গ্রীষ্মের কোনো এক সন্ধ্যায় সিরাজ পরিবার জিনজিরা প্রাসাদ থেকে নেমে বুড়িগঙ্গা নদীর বুকে এক নৌকায় আরোহণ করে। নৌকা যখন বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরীর সঙ্গমমূলে ঢাকাকে পেছনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন মীরননিযুক্ত ঘাতক বাকির খান নৌকার ছিদ্রস্থান খুলে দিয়ে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই সবাই তলিয়ে যান বুড়িগঙ্গা। পুরো প্রাসাদ ও এর আশপাশ মালিকি ও তত্ত্বাবধায়ক পরিবারের পূর্বপুরুষ হাজী অজিউল্যাহ ব্রিটিশ আমলে ১৪ শতক জমি সাফ কবলা মূলে খরিদসূত্রে মালিক। ওয়ারিশসূত্রে বর্তমান মালিক ও পরিবার প্রধান হলেন জাহানারা বেগম এবং হাজী অজিউল্যাহ তার শ্বশুর। একদা এটা ছিল নির্জন গ্রাম যার নাম হাওলি বা হাবেলী। বর্তমানে ঘিঞ্জি বসতি। ছোট গলিপথে একটু এগোতে একটা প্রবেশ তোরণ। তোরণের দুই পাশে স্থায়ী ভবন নির্মাণ করে আবাস গড়ে তোলা হয়েছে। চার দিকে দোকানপাট, ঘরবাড়ি, অট্টালিকা প্রবেশ অনেক কষ্টসাধ্য।
২৮. রোজ গার্ডেনঃ
ঢাকা শহরস্থ সূত্রাপূর থানার এলাকাধীন ১৩ কে. এম. দাস লেন সংলগ্ন ভূমিতে রোজ গার্ডেন নামক সংরক্ষিত ঐতিহাসিক ইমারতের অবস্থান। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঢাকার একজন বেশ নামকরা জমিদার ছিলেন হৃষিকেশ দাস! সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসছিলেন তিনি, তাই ঢাকার খানদানি পরিবার গুলো তাকে তেমন পাত্তা দিত না। কথিত আছে, একবার তিনি সে সময়ের ঢাকার বিখ্যাত বলধার জমিদার নরেন্দ্র নারায়ন রায় চৌধুরীর বাগানবাড়ি বলধা গার্ডেনের এক জলসায় গিয়েছিলেন! সেখানে সে কোনভাবে প্রচন্ড অপমানিত হয়েছিলেন! এরই প্রেক্ষিতে তিনি বলধা গার্ডেনের চাইতে অনেক বেশি সুন্দর এমন এক বাগান বাড়ি বানাতে চাইলেন যাতে চারিদিকে আলোড়ন পরে যায়।
হৃষিকেশ রোডে (তখন এ নাম ছিল না) তখন তিনি ২২ বিঘা জমি কিনে সেখানে ১৯৩০ সালে প্রথমে বানালেন একটি গোলাপের বাগান, পরের বছর ১৯৩১ তৈরি করলেন কারিন্থিয়ান পিলারে ঘেরা এই সুরম্য প্রাসাদ স্থাপত্যটি। বাগানে ছিল গোলাপ ফুলের আধিক্য, নানা প্রজাতির গোলাপ ছিল সারা প্রাসাদ কমপ্লেকস জুড়ে! তাই এর নাম হলো ‘রোজ গার্ডেন’! এছাড়া বাগানে মার্বেল পাথরের মূর্তি, কৃত্রিম ফোয়ারা ইত্যাদিও ছিল, রোজ গার্ডেন হয়ে উঠেছিল তখন ঢাকার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বাগানে এখনও বেশ কয়েকটি শ্বেত পাথরের মূর্তি আছে। বেশির ভাগ মূর্তিই বাড়ির ভেতরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। আগে মূল বাড়ির সামনে সুদৃশ্য একটা বড় ঝর্ণা ছিল, যার ভগ্নাংশটি এখনও রয়ে গেছে। এখন বাড়ির ঠিক সামনেই একটা পুকুর আছে। ওপর পাশে বেশ কিছু তাল গাছের সারি। প্রাসাদের নীচ তলায় একটি বড় হল ঘর সহ আটটি কামরা আর উপরের তলায় একটা বড় নাচঘর সহ পাঁচটি কামরা আছে। তবে ভবনটি নির্মানের কিছুকাল পরেই হৃষিকেশ দাস দেউলিয়া হয়ে পরলে তিনি এই প্রাসাদ বিক্রি করে দেন বই ব্যাবসায়ী আবদুর রশিদের কাছে। তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরী। সত্তর সালের দিকে ‘রোজ গার্ডেন’ লীজ দেয় হয় ‘বেঙ্গল স্টুডিও’কে। ১৯৮৯ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ‘রোজ গার্ডেন’কে সংরক্ষিত ভবন বলে ঘোষণা করে। এই রোজ গার্ডেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও সাক্ষি হয়ে আছে, ১৯৪৯ সালে এখানেই গঠিত হয়েছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ!
২৯. লালকুঠিঃ
এটি নর্থব্রুক হল নামেও পরিচিত। বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে ফরাশগঞ্জ মহল্লায় অবস্থিত। ইমারতটিকে বাইরের দিক থেকে পিরামিডের মত মনে হয়। মাঝের হল ঘরটির উপরে রয়েছে মোঘল ধাঁচে তৈরী একটি আদর্শ গম্বুজ। গোটা ইমারতটি লাল রঙে রঙিন বলে এর নাম হয়েছে লালকুঠি। এর স্থাপত্যশৈলীতে মুঘল ও ইউরোপীয় প্রথাসিদ্ধতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। বাংলায় ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান ও ভবনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় বা গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুক (১৮৭২-৭৬ খ্রিঃ) ১৮৭৪ সালে এক সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। নর্থব্রুকের এই ঢাকা সফরকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে ঢাকার প্রখ্যাত ধনী ব্যক্তি ও জমিদারগণ ‘টাউন হল’ ধাঁচের একটি হল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সে সময় রাজা রায় বাহাদুর ও দানশীল প্রখ্যাতনামা ধনী ও জমিদারগণ দশ হাজার পাঁচ হাজার করে প্রচুর চাঁদা দানের মাধ্যমে এই হলের নির্মাণ তহবিল গঠন করেন। প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব অভয় চরণ দাস ছিলেন উদ্যোক্তা কমিটির সেক্রেটারি, যিনি ঢাকার আরো বহু লোকহিতকর কর্মকান্ডের সঙ্গেও আমৃত্যু উদ্যোক্তা হিসেবে জড়িত ছিলেন। ১৮৭৯ সালে নর্থব্রুক হলের নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং ঢাকার তৎকালীন কমিশনার ১৮৮০ সালের ২৪ মে নর্থব্রুক হলের দ্বারোদ্ঘাটন করেন। পরবর্তীতে নর্থব্রুক হলকে গনগ্রন্থাগারে রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৮৮২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি নর্থব্রুক হলের সাথে ‘জনসন হল’ নামে একটি ক্লাবঘর মতান্তরে গণপাঠাগার সংযুক্ত করা হয়। যদিও তা ‘নর্থব্রুক হল লাইব্রেরী’ নামেই খ্যাত ছিলো। পাঠাগারটির সংগ্রহের খুব সুনাম ছিলো। এই পাঠাগার গড়ে তোলার জন্য প্রাথমিকভাবে যে তহবিল সংগ্রহ করা হয়, তাতে ভাওয়ালের রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ পাঁচ হাজার, ত্রিপুরার মহারাজ এক হাজার, বালিয়াটির জমিদার ব্রজেন্দ্র কুমার রায় এক হাজার, রানী স্বর্ণময়ী সাতশ’, কালীকৃষ্ণ পাঁচশ’ এবং বিশ্বেশরী দেবী পাঁচশ’ টাকা দান করেছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমে এক হাজার বই নিয়ে ১৮৮৭ সালে পাঠাগারটি খোলা হয়। এই পাঠাগারের জন্য নাকি বিলেত থেকে বই এনে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাঠাগারের অনেক বই নষ্ট হয়ে যায়। নর্থব্রুক হল নির্মাণের পর ঢাকার জাকজমকপূর্ণ নাগরিক অনুষ্ঠানগুলো এখানেই আয়োজন করা হতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুত্র রথীন্দ্রনাথ, পুত্রবধু প্রতিমা ও অন্যান্যসহ শেষবার ঢাকায় আসেন ১৯২৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন বক্তৃতা, অনুষ্ঠান ও সংবর্ধনাসভায় অংশগ্রহণ করেন। এবং তাঁর ঢাকা পৌঁছার দিনই অর্থাৎ ৭ তারিখ বিকেলে ঢাকার নাগরিক সমাজ এই লালকুঠির নর্থব্রুক হলে এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় উষ্ণ সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।
৩০. বিবি চম্পার মাজারঃ
পুরানো ঢাকায় অবস্থিত ছোট কাটরার ভিতরে বিবি চম্পার মাজার অবস্থিত। জনশ্রুতি অনুযায়ী শায়েস্তা খান যখন ঢাকায় ছিলেন তখন বিবি চম্পা নামে তার একজন উপ-পত্নী ছিলেন। বিবি চম্পার কবরের ওপর শায়েস্তা খান একটি স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করেন। এক গম্বুজ, চার কোণা, প্রতিপাশে ২৪ ফুট দীর্ঘ ছিল স্মৃতিসৌধটি। তায়েশ লিখেছেন, 'পাদ্রী শেফার্ড ওটা ধ্বংস করে দিয়েছেন।' শেফার্ড বোধ হয় কবরটি মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন। বিবি চম্পা কে ছিলেন তা সঠিক জানা যায় নি।
৩১. কমলাপুর রেলস্টেশনঃ
ঢাকা তথা দেশের অন্যতম আধুনিক স্থাপত্য নিদর্শন কমলাপুর রেলস্টেশন। ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহত্তম এবং কেন্দ্রীয় রেলষ্টেশন। এখানে পারিসারিক ও কারিগরী উদ্ভবনার চূড়ান্ত মিল ঘটানো হয়েছে। রেল স্টেশনে কতগুলো ছাড়াছাড়া দালানকে ফুলের পাপড়ির আকৃতিযুক্ত ছাউনি দিয়ে ঢেকে এক ছাদের তলে একসূত্রে গাঁথা হয়েছে। এটা ছিল স্থাপত্য শিল্পের সৃজনশীল প্রকাশ। ১৯৬০ এর দশকে ফুলবাড়িয়া, ঢাকার একমাত্র রেলষ্টেশনের সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে কমলাপুরে রেলস্থাপনা গড়ে উঠে। সেই সময় কমলাপুর ছিল পুরোপুরি ধানক্ষেত। তৎকালীন সময়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বুয়েটের আমেরিকান শিক্ষক রবার্ট বোগেই-এর তত্ত্বাবধানে এটি নির্মিত হয়। ১৯৬৯ সালে এখানে রেল চলাচলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়।
৩২. চামেলী হাউসঃ
ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকলা একটা চমৎকার নিদর্শন চামেরী হাউস। চামেরী হাউস মূলত: নির্মিত হয়েছিল ইংরেজ প্রশাসকদের জন্য ১৯২৬ সালে! ১৯০৫ সালে ঢাকা পূর্ববঙ্গ এবং আসামের রাজধানী হবার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মিন্টো রোড এলাকায় অনেকগুলো ভবন নির্মান করা হয়েছিল প্রশাসকদের থাকবার জন্য, চামেরী হাউস তাদের মধ্যে একটি! রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ঢাকা পরিভ্রমনের সময়ে এই চামেরী হাউসেই থেকেছিলেন! বর্তামনে অবশ্য আপনারা এই ভবনের সামনে নামফলকে দেখতে পাবেন "চামেলি হাউস"! যদিও চামেলি আরব চামরী শব্দের অর্থ একই, তবে মুনতাসির মামুন উল্লেখ করেছেন আদিতে ভবনটি পরিচিত ছিল 'চামেরী হাউস' নামেই। ইংরেজ আমলে অবিবাহিত ইংরেজ সিভিলিয়ানরা কয়েকজন মিলে যে ভবনে থাকতো তাকে বলা হতো 'চামেরী' (ইংরেজি চাম বা বন্ধু থেকে)। বঙ্গভঙ্গের পর যতদিন ঢাকা রাজধানী ছিল ততদিন এটা ইংরেজ ব্যাচেলর প্রশাসকদের আবাসস্থল বা মেস হিসাবেই ব্যবহৃত হতো! পরবর্তী কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে, রমনা এলাকার সব ভবন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করা হয়, তখন চামেরি হাউস হয়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলো! অধ্যাপকদের বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো। পরবর্তিতে ১৯২৯ সালে মুসলিম হলের কিছু আবাসিক ছাত্রকে বাংলোটি বরাদ্ধ দেয়া হয়েছিল!
১৯৩৮ সাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রিদের হল নিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছিল, ১৯৫৭ সালে রোকেয়া হল নির্মানে আগ পর্যন্ত এটা ছাত্রি নিবাসই ছিল! এরপর চামেরী হাউস সরকারের তত্বাবধানে চলে যায়, বর্তমানে এখানে 'সিরাডাপ' এর কার্যালায়। হাইকোর্টের মোড়ে, শিক্ষা অধিদপ্তরের পাশে গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে চামেরী হাউসকে!
৩৩. বিউটি বডিং:
পুরোনো ঢাকার বাংলাবাজারে অনেক ইতিহাসের সাক্ষী বিউটি বোর্ডিং। পুরাতন হলুদ রঙের কয়েকটা দোতলা ঘর, আবার দেয়ালের কোথাও কোথাও রং উঠে যাওয়া ফ্যাকাশে ভাব। বোর্ডিংটার মাঝখানে আছে সুন্দর ছোট একটা বাগান। বিউটি বোর্ডিং- এর বর্তমান মালিক তারক সাহা। তার বাবা আর কাকা মিলে ১৯৪৯ সালে বিউটি বোর্ডিং ও রেস্টুরেন্টটি গড়ে তোলেন। প্রথম দিকে এখানে শুধুই রেস্টুরেন্ট ছিল পরে আবাসিক ব্যবস্থাও করা হয়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানেই পাকিস্তানী হানাদারদের গুলিতে তার বাবা সহ আরও ১৭ জন শহীদ হন। সেই বীর বাঙ্গালীদের স্মৃতি তিনি সংরক্ষণ করে রেখেছেন আজও। ২৮ মার্চ ১৯৭১ এ শহীদ হওয়া ব্যাক্তির মধ্যে ছিলেন সন্তোষ কুমার দাশ, হেমন্ত কুমার সাহা, অহিন্দ্র চৌধুরী শংকর, প্রভাত চন্দ্র সাহা, নির্মল রায় খোকাবাবু, হারাধন বর্মন, প্রেমলাল সাহা, কেশবদেও আগরলাল, সামশ্ ইরানী, জোসেফ কোরাইয়া, শীতল কুমার দাশ, অকিল চক্রবর্তী, সাধন চন্দ্র রায়, শুকুভঞ্জন দেব, খিতিশ চন্দ্র দে, নুর মোহাম্মদ মোল্লা। আমাদের দেশের অনেক খ্যাতনামা, বিশ্বনন্দিত মানুষদের পছন্দের জায়গা ছিল বিউটি বোর্ডিং। চলচ্চিত্র শিল্প-সাহিত্য, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, প্রকাশক, শিক্ষক, এলাকাবাসী সব ধরনের মানুষই এখানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পাশাপাশি আড্ডা গুজব করতেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হচ্ছেন কবি শামসুর রহমান, প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক , জিয়া আনসারি, আমিরুল হক জিলু, ড.আলাউদ্দীন আল আজাদ, নায়করাজ রাজ্জাক, সুভাষ দত্ত, আব্দুল জব্বার খান, দেবদাস চক্রবর্তী, নিতুন কুন্ডু, মোস্তফা মনোয়ার, কবি সমুদ্র গুপ্ত, সন্তোষ গুপ্ত, এনায়েতুল্লাহ খান, সমর দাশ, শিকদার আমিনুল হক সহ আরো অনেকে। বোর্ডিং-এ এখন মুলত: মানুষ থাকার জন্যই আসে। পাশাপাশি দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও আছে। বিউটি বোর্ডিং এর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতিবছর একবার পুণর্মিলনী হয়ে থাকে।
৩৪. জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠঃ
ঢাকার মিরপুর সেকশন-১০, ব্লক-ডি এ অবস্থিত এই স্মৃতিপীঠ। সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় খনন করে এখানে ৭০টি মাথার খুলি সহ অসংখ্য অস্থিখন্ড পাওয়া গেছে। জল্লাদখানার সেই অভিশপ্ত পাম্প হাউসে কি ঘটেছিল তার ইতিহাস কক্ষের দরজার উপরে বাংলা ছাড়াও আরও পাঁচটি ভাষায় লেখা রয়েছে । ভেতরে দেয়ালে লেখা রয়েছে এখানে শহীদদের নাম, রয়েছে সেই অভিশপ্ত মৃত্যুকুপ। এছাড়া এখানে রয়েছে দেশের চারশত বধ্যভূমির তালিকা, প্রধান ছয়টি বধ্যভূমি থেকে আহরিত মাটি, বধ্যভূমির ইতিহাস,আলোকচিত্র সংকলন ইত্যাদি।
খ) ধর্মীয় :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. তারা মসজিদ :
বাংলাদশের পুরানো ঢাকার আরমানিটোলার আবুল খয়রাত সড়কে অবস্থিত ‘তারা মসজিদ’। খ্রিষ্টীয় আঠারো শতকে ঢাকার জমিদার মির্জা গোলাম পীর (মির্জা আহমদ জান) এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। তারা মসজিদের আরও কিছু প্রচলিত নাম আছে, যেমন- মির্জা গোলাম পীরের মসজিদ বা সিতারা মসজিদ। সতের শতকে দিল্লি, আগ্রা ও লাহোরে নির্মিত মোঘল স্থাপত্য শৈলী অনুসরণে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল। মসজিদের কোথায়ও এর তৈরির সময় উল্লেখ নেই বলে কবে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়, তার সুস্পষ্ট কোনো নথি পাওয়া যায়নি। তবে, মসজিদটি তৈরির পর ১৮৬০ খ্রিষ্টাব্দে মির্জা গোলাম পীর মৃত্যুবরণ করেন। প্রথম থেকেই মসজিটি আয়তাকার ছিল। মির্জা গোলাম পীর তৈরির আদি মসজিদটির পরিমাপ ছিল দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট (১০.০৬ মিটার) এবং প্রস্থে ১২ ফুট (৪.০৪ মিটার), গম্বুজ ছিল তিনটি। এর ভিতরে মাঝের গম্বুজটি অনেক বড় ছিল। সাদা মার্বেল পাথরের গম্বুজের উপর নীলরঙা তারার নকশা যুক্ত ছিল। সেই থেকে এই মসজিদটি তারা মসজিদ নামে পরিচিত হয়ে উঠে। এর পূর্ব দিকে মসজিদে প্রবেশর জন্য তিনটি এবং উত্তর দিকে ১টি এবং দক্ষিণ দিকে ১টি দরজা ছিল।১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার তৎকালীন স্থানীয় ব্যবসায়ী, আলী জান বেপারী মসজিদটির সংস্কার করেন। এই সময় মসজিদটির আকার বৃদ্ধি করা হয়। এই সময় এর পূর্বদিকে একটি বারান্দা যুক্ত করা হয়। এই সময় মসজিদের মেঝে মোজাইক করা হয়। চিনিটিকরি কৌশলের এই মোজাইকে ব্যবহার করা হয় জাপানী রঙিন চীনা মাটির টুকরা এবং রঙিন কাঁচের টুকরা। ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদটির পুনরায় সংস্কার করা হয়। এই সময় পুরনো একটি মেহরাব ভেঙে দুটো গম্বুজ আর তিনটি নতুন মেহরাব বানানো হয়। সব মিলিয়ে বর্তমানে এর গম্বুজ সংখ্যা পাঁচটিতে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে মসজিদের জায়গা সম্প্রসারিত হয়।মসজিদের বতর্মান দৈর্ঘ্য ৭০ ফুট (২১.৩৪ মিটার), প্রস্থ ২৬ ফুট (৭.৯৮ মিটার)। এছাড়া মসজিদের দেয়াল ফুল, চাঁদ, তারা, আরবি ক্যালিওগ্রাফিক লিপি ইত্যাদি দিয়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
২. ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির :
ঢাকার বকশী বাজার এলাকায় অবস্থিত মনোরম স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম তীর্থ স্থান। এটি বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির। প্রবাদ রয়েছে, মন্দিরটি ১১শ শতকে মহারাজ বল্লাল সেন কর্তৃক নির্মিত হয়। এ মন্দির বিষয়ে কথিত আছে , মহারাজ মানসিংহ শ্রীপুরের কেদার রায়কে পরাস্ত ও হত্যা করে ঢাকায় আসেন এবং এখানে একটি শিবমন্দির স্থাপন করেন। এছাড়া কথিত আছে বল্লাল সেন স্বপ্নে আদেশ পেয়েছিলেন এখানে জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়ে আছে এক দেবী তাকে আবিষ্কার করে মন্দির নির্মাণ করে পূজার ব্যবস্থা করেন বলে সেখান থেকেই এর নাম হয় ঢাকেশ্বরী। অনেকে মনে করেন ঢাকেশ্বরী নাম থেকে ঢাকা নামের উৎপত্তি হয়েছে। মন্দিরটি নির্মাণশৈলীতে দুই ধরণের স্থাপত্যরীতির মিশ্রণ রয়েছে। বস্তুত এ মন্দির প্রাঙ্গণে দেবী দুর্গা ও সন্তোষী মায়ের মন্দির ছাড়াও ৪টি শিব মন্দিরে আছে ৪টি শিবলিঙ্গ। ঢাকেশ্বরী মূল মন্দির একতলা হলেও দেখতে মনোরম। মন্দিরের মধ্যকার স্বর্ণময়ী দেবী দুর্গার পূজো-অর্চণা হয় প্রতিদিনই।
৩. গুরু দোয়ারা নানক শাহী :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের ধার ঘেঁষে আছে এক শিখ মন্দির বা সঙ্গত। সঙ্গতের ভেতরে একদিকে আবাসিক গৃহ। প্রাঙ্গনে আছে একটি কুঁয়া, কিছু সমাধি, কোন এক গুরুর পদচিহ্ন সম্বলিত একটি পাথর। এটি নির্মিত হয়েছিল সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে (১৬০৮-১৬২৮) ষষ্ঠ শিখগুরু হরগোবিন্দ শিং কর্তৃক বাংলা অঞ্চলে প্রেরিত শিখ পুরোহিত আলমাসত-এর প্রচেষ্টায় এই গুরুদুয়ারাটি নির্মিত হয় বলে কথিত আছে। তবে অরেকে মনে করেন এটি ১৮৩৩ সালে দিকে নির্মিত হয়েছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলেই গুরুদুয়ারায় প্রবেশ করে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রার্থণাস্থলকে বলা হয় ’দরবার সাহেব’। গুরুদুয়ারা উপাসনালয়ের প্রবেশদ্বারের সংখ্যা সাধারণত অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপত্যের চেয়ে বেশি থাকে। প্রত্যেক গুরুদুয়ারায় হলুদ রঙের পতাকা টাঙানো থাকে। একে বলা হয় ‘নিশান সাহেব’। এর দুই দিকে তলোয়ারের ছবি আকাঁ থাকে, যা ‘খান্ডা’ নামে পরিচিত। শিখ-জীবনেরজাগতিক ও আধ্যাত্মিক মিশ্রণের প্রতীক এই নিশান। অতীতে গুরুদদুয়ারা নানকশাহীর উত্তরদিকে দিয়ে একটি প্রবেশদ্বার ছিল। দক্ষিণ দিকের অংশে ছিল একটি কূপ ও সমাধিস্থল এবং পশ্চিমে ছিল একটি শান বাঁধানো পুকুর। মূল উপাসনালয়ের উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল অফিস ও আবাসিক ব্যবস্থা এবং পূর্বদিকে থাকতেন তত্ত্ববধায়ক। এছাড়া ভক্তদের বসার জন্য ছিল কয়েকটি কক্ষ। সবমিলিয়ে ছিল মোট নয়টি কক্ষ। গুরুদুয়ারাটি বর্তমানে ভালো অবস্থায় টিকে আছে। বর্গাকার ড্রামের উপর স্থাপিত চমৎকার গম্বুজবিশিষ্ট ইন্দো-ইসলামিক রীতিতে নির্মিত এই বর্গাকার স্থাপনাটির প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য বাইরের দিকে প্রায় ৩০ ফুট।
৪. চুরিহাট্টা মসজিদ:
১৬৫০ সালে মোহাম্মাদী বেগ কর্তৃক নির্মিত পুরাতন ঢাকার লালবাগে অবস্থিত চুরিহাট্টা মসজিদ ধর্মীয় ঐতিহ্যের নিদর্শন।
৫. মীরপুরের দরগাহ :
ঢাকার দরগাহগুলোর মধ্যে মীরপুরের দরগাহ অন্যতম। এটি হযরত শাহ্ আলী বাগদাদী রহমাতুল্লাহি আলায়হি-এর মাজার। কিংবদন্তী অনুসারে হযরত শাহ আলী হলেন সেই চল্লিশজন ধর্মপ্রচারকের একজন, যারা বাগদাদ থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন ইসলাম প্রচারে। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করতে হয়রত শাহ আলী আগমন করেন । তিনি ফরিদপুর অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে অবদান রাখেন। ঢাকার মীরপুরে তাঁর দরগাহ্ রয়েছে।
৬. জয়কালী মন্দির :
ঠাটারী বাজার ও ওয়ারীর মধ্যবর্তী স্থানে ২৪ জয়কালী মন্দির ষ্ট্রীটে জয়কালী মন্দির অবস্থিত যা প্রায় তিনশো বছরের পুরনো। জয়কালী মন্দিরের প্রাচীরঘেরা চত্বরটির ভেতরে দুটি মন্দির রয়েছে। হিন্দু ধর্মাবলাম্বীদের নিকট এর বেশ গুরুত্ব রয়েছে। কালী দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এটি একটি হিন্দু মন্দির। সকল বয়সের হিন্দু ধর্মাবলাম্বীরা কালী দেবীর পূজো দিতে এখানে আসেন।
৭. হাজী খাজা শাহবাজ মসজিদ :
মুঘল সুবেদার মুহম্মদ আজমের সময় ১৬৭৯ সালে রমনা রেসকোর্সের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নির্মিত হয়েছিল হাজী শাহবাজ মসজিদ। হাজী শাহবাজের মসজিদটি ৬৮ ফুট দীর্ঘ এবং ২৬ ফুট চওড়া। মুঘল স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি এখনও বিদ্যমান আছে।
৮. খান মোহাম্মাদ মৃধা মসজিদ :
লালবাগ দূর্গের পশ্চিমে পুরনো ঢাকায় আতিশখানায় দাঁড়িয়ে আছে সুন্দর এ মসজিদটি। এই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির ভিত্তি প্রায় সতের ফুট উঁচু একটি প্ল্যাটফর্মের ওপর । প্ল্যাটফর্মের নীচে টানা করিডোর, পাশে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ। এখানে আলো ছায়ার খেলা মনোমুগ্ধকর। ১৭০৬ সালে খান মুহাম্মদ র্মদা এটি নির্মাণ করেন। এটি একি আবাসিক ম্রাদ্রাসা মসজিদ। বর্তমানে এটি ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
৯. বায়তুল মোকাররম মসজিদ :
এটি বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে স্থপতি টি. আব্দুল হুসেন থারিয়ানির নক্সায় ও কাবা শরীফের আদলে ১৯৬৮ সালে এটি নির্মাণ করা হয়। প্রধান ভবনটিতে সাদা রং-এর ব্যবহার ও প্রায় কিউবিক আকৃতির অবকাঠামোসহ সমগ্র নকশাটিতে বর্তমান সময়ের স্থাপত্যিক প্রভাব প্রতিফলিত হয়। এই মসজিদে বর্তমানে প্রায় ৪০,০০০ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারে।
১০. শাহী ঈদগাহ :
ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার সাত মসজিদ রোডে অবস্থিত। ঈদাগাহের দেওয়ালের শিলালিপি অনুযায়ী সুবাদার শাহ সুজার দীউয়ান মীর আবুল কাসিম কর্তৃক ১৬৪০ সালে এটি নির্মিত হয়। আশেপাশের ভূমি থেকে এটি ১.৮৩ মিটার উঁচুতে অবস্থিত একটি উন্মুক্ত চত্বর। আদি ঈদগা চত্বরের পরিমাপ ছিল ৭৪.৬৮ বাই ৪১.৭৬ বর্গমটিার। ঈদগায়ের পশ্চিম দিকের টানা দেয়ালটি পথচারীদের থেকে নামাজিদের পৃথক করার জন্য নির্মিত। প্রথম অবস্থায় ঈদগায়ের বেষ্টনী-প্রাচীরের উচ্চতা ছিল ৪.৫৭ মিটার। ঈদগাহের পশ্চিম দেয়ালে কেন্দ্রীয় মিহরাব এবং দুপাশে অপেক্ষাকৃত ছোট তিনি করে মিহরাব রয়েছে। মিহরাবটি অর্ধ অষ্টভুজাকৃতির এবং চতুর্কেন্দ্রিক সামান্য ঢালূ খিলান-বিশিষ্ট। এটি ঢাকা শহরের একটি অন্যতম স্থাপত্য নির্দশন।
১১. রামকৃষ্ণ মিশন :
শ্রীরামকৃষ্ণের ধর্মীয় অনুভূতি এবং জীবনদর্শনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন হল বিশ্বব্যাপী রামকৃষ্ণ আন্দোলন বা বেদান্ত আন্দোলন নামে পরিচিত আধ্যাত্মিক আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। রামকৃষ্ণ মিশন একটি মানবকল্যাণকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ১৮৯৭ সালের ১ মে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। রামকৃষ্ণ মিশন জনস্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ত্রাণকার্য, গ্রামোন্নয়ন, আদিবাসী কল্যাণ, বুনিয়াদি ও উচ্চশিক্ষা এবং সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সেবামূলক কাজ করে থাকে। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদিত হয় শতাধিক সন্ন্যাসী ও সহস্রাধিক গৃহস্থ ভক্তের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। রামকৃষ্ণ মিশনের মূল আদর্শটি হল কর্মযোগ। রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয় কলকাতার নিকটস্থ হাওড়া শহরে অবস্থিত বেলুড় মঠে। মিশন প্রাচীন হিন্দু বেদান্ত দর্শনের অনুগামী। রামকৃষ্ণ মিশন রামকৃষ্ণ সংঘের সন্ন্যাসী সংগঠন রামকৃষ্ণ মঠ কর্তৃক অনুমোদিত।
১২. সাতগম্বুজ মসজিদ :
ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত মোগল শাসনের ধারাবাহিকতায় যে স্থাপত্যরীতি প্রচলিত রয়েছে তারই উদাহরণ ‘সাত গম্বুজ মসজিদ’টি। ধারণা করা যায়, ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে নবাব শায়েস্তা খাঁ মসজিদটি নির্মাণ করেন। অন্য এক তথ্যে জানা যায়, নবাব শায়েস্তা খাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র বুজুর্গ উদ্দিন (উমিদ) খাঁ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমানে, মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্বাবধানে আছে। এর ছাদে রয়েছে তিনটি বড় গম্বুজ এবং চার কোণের প্রতি কোনায় একটি করে অনু গম্বুজ থাকায় একে সাত গম্বুজ মসজিদ বলা হয়। মসজিদের গম্বুজ পদ্ম-চূড়া শোভিত। মসজিদের আনভূমিক প্যারাপেট এবং গম্বুজের ড্রামে রয়েছে সারিবদ্ধ মেরলোন নকশা। মিহরাবগুলোর সামনের অংশ খাঁজকাটা। কেন্দ্রীয় মিহরাবের ফ্রেমের উপরের দিকে বদ্ধ শিখরের মতো ফ্রিজ নকশা রয়েছে। কোণের অষ্টভূজি বুরুজগুলির উপর স্থাপিত ফাঁপা গম্বুজ মসজিদটিকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করে তুলেছে।এর আয়তাকার নামাজকোঠার বাইরের দিকের পরিমাণ দৈর্ঘ্যে ১৭.৬৮ এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার এর পূর্বদিকের গায়ে ভাঁজবিশিষ্ট তিনটি খিলান এটিকে বেশ আকর্ষণীয় করে তুলেছে। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব রয়েছে। দূর থেকে শুভ্র মসজিদটি অত্যন্ত সুন্দর দেখায়। মসজিদের পূর্বপাশে এরই অবিচ্ছেদ্য অংশে হয়ে রয়েছে একটি সমাধি। কথিত আছে, এটি শায়েস্তা খাঁর মেয়ের সমাধি। সমাধিটি ‘বিবির মাজার’ বলেও খ্যাত। এ কবর কোঠাটি ভেতর থেকে অষ্টকোনাকৃতি এবং বাইরের দিকে চতুষ্কোনাকৃতির। বেশ কিছুদিন আগে সমাধিক্ষেত্রটি পরিত্যক্ত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত ছিল। বর্তমানে এটি সংস্কার করা হয়েছে। মসজিদের সামনে একটি বড় উদ্যানও রয়েছে। একসময় মসজিদের পাশ দিয়ে বয়ে যেত বুড়িগঙ্গা। মসজিদের ঘাটেই ভেড়ানো হতো লঞ্চ ও নৌকা। কিন্তু বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও কষ্টকর। বড় দালানকোঠায় ভরে উঠেছে মসজিদের চারপাশ।
১৩. করতলব খান মসজিদ :
পুরাতন ঢাকার বেগম বাজার এলাকায় অবস্থিত। ১৭০১-০৪ সালে দেওয়ান মুর্শিদকুলী খান ওরফে করতলব খান এটি নির্মাণ করেন। মসজিদটি বেগম বাজার মসজিদ নামেও পরিচতি। ভবনটির অলংকরণে এর স্থাপাত্যিক বিষয়ের ওপর বেশী গুরুত্বআরোপ করা হয়েছে। বিশেষ করে প্রবেশ পথগুলির পার্শ্ববর্তী অলংকৃত ক্ষুদ্র মিনার, অভিক্ষিপ্ত মিহরাব, ছত্রী, ছোট গম্বুজ এবং পদ্ম ও কলস শোভিত ফেনিয়াল উল্লেখযোগ্য। এগুলি ছাড়া সমস্ত ভবনটি সাধারণ প্লাস্টার করা যা কিনা বাংলায় মুঘল স্থাপত্যের এক স্বতন্ত্র নিদর্শন।
১৪. সেন্ট থমাস চার্চ :
ঢাকার আদি গীর্জাগুলির অন্যতম বাহাদুর শাহ পার্কের উত্তরে সেন্ট থমাস অ্যাংলিকান চার্চ বা গীর্জা অবস্থিত। ১৮১৯ সালে কয়েদীদের শ্রমের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছিল এই গীর্জা এবং ১৮২৪ সালে বিশপ হেবার ঢাকা পরিদর্শন কালে এর উদ্বোধন করেন। বাইরের দিকে এর পোর্চ, খাঁজকাটা প্যারাপেট, ক্লক টাওয়ার এবং গথিক রীতির খিলান ইংল্যান্ডের পল্লী গির্জাগুলোর মতো। এই উপমহাদেশে গির্জাটির নির্মাণ-রীতি আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হতো। প্রধান হলটির ছাদ কাঠের স্তম্ভের উপর ভর করা। কিন্তু বারান্দাগুলোর ছাদ ঢালু, কড়ি-কাঠের উপর স্থাপিত। আয়তাকার হল-ঘরটি সুবিন্যস্ত এবং সবকিছু ছাপিয়ে দৃশ্যমান খাঁজকাটা দুটি স্তম্ভ, যা কোনো প্রকার ভার বহন করছেনা। বেদীটির অবস্থান পূর্ব-প্রান্তে। আকৃতিতে ছোট হলেও এটি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় গির্জা।
১৫. বিনত বিবির মসজিদ :
ঢাকার সবচেয়ে পুরনো মসজিদ বিনত বিবির মসজিদ। নারিন্দা পুলের উত্তরে ছোট এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল ঢাকা মুগল রাজধানী হওয়ার আগে। মসজিদটির স্থাপত্য শৈলী প্রাক মুঘল। বর্তমানে অবিদ্যমান একটি শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি পুনঃস্থাপিত ইলিয়াস শাহী বংশের সর্বশেষ সুলতান জালালউদ্দীন ফতেহ শাহের রাজত্বকালে (১৪৮১-৮৬ খ্রিঃ) নির্মিত হয়। মসজিদটি এখন পুরোপুরি নতুনভাবে নির্মিত এবং মূল মসজিদের উপর দ্বিতল বিশিষ্ট অট্টালিকা সংযোজিত হয়েছে। অষ্টাভূজাকৃতির কর্ণার বুরুজসহ মূল মসজিদটি ছর গম্বুজাবৃত বর্গাকৃতির একটি ছোট ইমারত, এবং প্রায় এক মটিার পুরু দেয়াল বিশিষ্টি এই মসজিদের অভ্যন্তরীণ পরিমাপ ছিল ৩.২০ মিটার। পূর্বদিকে তিনটি দরজার মাধ্যমে মসজিদ অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যেত এবং গম্বুজ সরাসরি স্কুইঞ্চ কর্বেল পান্দানতীফ এর উপর ন্যস্ত ছিল। মূল অলঙ্করনের কিছুই এখন বর্তমান নেই।
১৬. মুসা খান মসজিদ :
ঢাকায় বারোভুঁইয়াদের বংশধরদের কীর্তির মধ্যে একটি স্থাপনা বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে এখনো। এটি একটি মসজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের উত্তর-পশ্চিম কোণে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মলিন পুরোনো এ মসজিদ এখন চারপাশের বহুতল ভবনগুলোর আড়ালে পড়ে গেছে। তাই চট করে আর চোখে পড়ে না। নাম ‘মুসা খান মসজিদ’। ইতিহাস খ্যাত বারো ভুঁইয়াদের অন্যতম মসনদ-ই-আলা ঈশা খাঁর পুত্র মুসা খানের নামে মসজিদটির নামকরণ। মুসা খানের কবরও রয়েছে অদূরেই, মসজিদের পূর্ব-উত্তর পাশের মাঠের কোনায়। একটি হেলে পড়া পলাশগাছ নাম ফলকবিহীন সাদামাটা কবরটিকে ছায়া দিয়ে যাচ্ছে। পিতা ঈশা খাঁর মতো অতটা পরাক্রমশালী ও খ্যাতিমান না হলেও বাংলার ইতিহাসে মুসা খানের নাম একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। বিশেষ করে, রাজধানী ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা সুবাদার ইসলাম খান এখানে আসার পথে যাঁদের প্রবল বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন, দিওয়ান মুসা খান তাঁদের অন্যতম। বেশ কয়েক দফা প্রবল লড়াই হয়েছিল দিওয়ান বাহিনীর সঙ্গে সুবাদার বাহিনীর। তার বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে মির্জা নাথানের বাহারিস্তান-ই-গায়বীতে। শেষ পর্যায়ে অবশ্য মুসা খান সুবাদার ইসলাম খানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সুবাদারের সঙ্গে সম্পর্কও সহজ হয়ে এসেছিল একপর্যায়ে। কার্জন হলের পশ্চিম দিকের চত্বরটি ‘বাগে-মুসা খান বা মুসা খানের বাগান বলে পরিচিত ছিল একসময়। মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের পাশেই জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও অধ্যাপক আনোয়ারুল আজিমের কবর। তারপর সীমানা প্রাচীর-সংলগ্ন নামিজউদ্দিন রোড। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের দ্বিতল বাসের সারি। ফলে একেবারে কাছে না গেলে মসজিদটি চোখে পড়ে না। দক্ষিণ দিকে ডিনের কার্যালয়ের সামনে দিয়ে একটি সরু রাস্তা ধরে আসতে হয় মসজিদে। নাম মুসা খান মসজিদ হলেও তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা নন বলেই ঐতিহাসিকদের সিদ্ধান্ত। এর স্থাপত্যশৈলী শায়েস্তা খানের স্থাপত্যরীতির মতো। সে কারণেই সন্দেহ। শায়েস্তা খান ঢাকায় আসেন আরও পরে। অধ্যাপক এম হাসান দানীর মতে, মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন মুসা খানের নাতি মনোয়ার খান। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনও তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতিবিস্মৃতির নগরী’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন ‘দানীর মতোই যুক্তিযুক্ত’। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াও তাঁর ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, মসজিদটির নির্মাতা সম্ভবত মুসা খানের পুত্র মাসুম খান অথবা পৌত্র মনোয়ার খান। পিতা বা পিতামহের নামে মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছিল বলেই তাঁর অনুমান। সপ্তদশ শতকের শেষ থেকে অষ্টাদশ শতকের শুরুর মধ্যে মসজিদটি নির্মিত বলে ঐতিহাসিকদের অনুমান। মুসা খান মসজিদটি দেখতে অনেকটা খাজা শাহবাজের মসজিদের (তিন নেতার মাজারের পেছনে) মতো। ভূমি থেকে উঁচু মঞ্চের ওপর মসজিদটি নির্মিত। নিচে অর্থাৎ মঞ্চের মতো অংশে আছে ছোট ছোট প্রকোষ্ঠ। এগুলো এখন বন্ধ। দক্ষিণ পাশ দিয়ে ১২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয় মসজিদের দরজায়। পূর্ব দিকে খোলা বারান্দা। চওড়া দেয়াল। পূর্ব-পশ্চিমের দেয়াল ১ দশমিক ৮১ মিটার ও উত্তর-দক্ষিণের দেয়াল ১ দশমিক ২ মিটার চওড়া। পূর্বের দেয়ালে তিনটি ও উত্তর-দক্ষিণে দুটি খিলান দরজা। ভেতরে পশ্চিম দেয়ালের মধ্যে একটি প্রধান ও পাশে দুটি ছোট মেহরাব। চারপাশের দেয়ালে মোগলরীতির নকশা। বাইরের দেয়ালের চার কোণে চারটি মিনারখচিত আট কোণ বুরুজ। তার পাশে ছোট ছোট মিনার। বুরুজ ও ছোট মিনার ১৬টি। ছাদে তিনটি গম্বুজ। মাঝেরটি বড়। ওপরের কার্নিশ নকশাখচিত। বাইরের দেয়ালের পলেস্তারা মাঝেমধ্যেই খসে গেছে। ছাদে ও কার্নিশে জন্মেছে পরগাছা।নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় হয় এখানে। ঢাকার পুরোনো দিনের গৌরবের স্মৃতি হয়ে আছে এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি।
১৭. আর্মেনীয় গির্জা :
৪ নং আরমানিটোলা সড়কে এর অবস্থান। প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর বিস্তৃত একটি পাঁচিল ঘেরা সমাধিস্থানের মাঝখানে ’হলি রিজারেকশন’ নামক আর্মেনীয় গির্জাটির অবস্থান। গির্জাটির প্রর্থনা হলের উপর স্থাপিত ১৭৮১ সালের একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, গির্জাটির পূর্বের একটি চ্যাপেলের ধ্বংসাবশেষের ওপর নির্মিত হয়। এর উত্তর ও দক্ষিণে রয়েছে বিশাল বারান্দা। পুর্ব-পশ্চিমে লম্বা আয়তাকার ভূমি-পরিকল্পনায় নির্মিত এটির পশ্চিম দিকে রয়েছে বারান্দা। সমাধিস্থানে নানান ধরণের কারুকাজ করা মোট ২৭০টি পাকা সমাধি আছে। অর্ধাবৃত্তাকার নির্ভত স্থানটি মুকুটের মতো অলংকৃত প্যারাটে সমৃদ্ধ। ভূমি থেকে উথ্থিত হয়েছে প্রার্থনাকক্ষটি। ১৮৪৯ সালে চার্লস পট কর্তৃক তেলরঙে আঁকা যিশুর ‘রাস্ট সাপার’ ও তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ-করণের চিত্র দিয়ে প্রার্থনার উর্ধ্বভাগ সজ্জিত। এর সঙে কলকাতার গির্জা এবং আর্মেনিয়ার ইখমিয়াদযিনের গির্জার কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। জোহান্স ক্যাপারাইট সারকাইজ কর্তৃক ১৮৩৭ সালে গির্জার আদি শীর্ষ-চূড়া ও ক্লক-টাওয়ারটি নির্মিত হয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এটি ভেঙে পড়ে।
১৮. হলি রোজারিও চার্চ :
রাজধানীর ফার্মগেইটের কাছেই তেজগাঁও এলাকায় হলি রোজারিও চার্চ। নতুন এবং পুরোনো, দুটি গির্জা এখানে আছে। পর্তুগীজরা পুরোনোটি ১৬৭৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আর নতুনটি তৈরি করা হয় ১৯৯৭ সালে। এটি ক্যাথলিক চার্চ। ফার্মগেইটে এসে পায়ে হেঁটেই পৌঁছানো যাবে এ গির্জায়। গির্জাটির লম্বা আয়তাকার কক্ষ রয়েছে যাতে ব্যসিলিকান গির্জার অনুরূপ নেভ, আইল ও পরিচল পথ রয়েছে। গৃহকোণটি প্রকৃতপক্ষে একটি ছোট বর্গক্ষেত্র। পূর্বদিকে সম্মুখভাগের প্রতিকোণায় কপুলা আচ্ছাদিত ফাঁপা বুরুজ রয়েছে। এই বুরুজের উপর খ্রিষ্টান ও মোঘল উপাদানের অপূর্ব সংমিশ্রণের স্মারক একটি ভাস্কর্য ছিল। তীক্ষ্ণাগ্র নকশা-করা কিরান-বিশিষ্ট প্রবশে-পথের দুই পাশে খাঁজযুক্ত পিরার রয়েচে। প্যানেলযুক্ত সম্মুখ-দেয়াল ও বাকানো ইভস্ শায়েস্তা খানের স্থাপত্যিক ধারাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ত্রিভূজাকৃতি পেডিমেন্ট কুমারী মেরী ও শিশুর প্রতিকৃতি রয়েচে। সম্মুখ-ভাগের উপরের অংশে ত্রিভূজাকৃতি রদরখ ধারণা করা হয় গির্জাটির ছাদ ঢালু চির। এর সঙ্গে একটি সমতল ছাদ যুক্ত করা হয়েছে।
১৯. ওয়ারি-নারিন্দা খ্রিস্টান গোরস্থান :
ওয়ারি ও নারিন্দা মহল্লা দুটির প্রান্তবর্তী স্থানে এর অবস্থান। প্রায় ১.৫ হেক্টর পাঁচিল ঘেরা চত্বরে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো কবর। এখানে বেশ কয়েকটি কবরে স্মারকসৌধ ও ইপিটাফ রয়েছে। কিছু কবরের উপরে আছে অপূর্ব ভাস্কর্য।
২০. চকবাজার শাহী মসজিদ :
পুরনো ঢাকার চকবাজার এলাকায় অবস্থিত। শিলালিপি অনুসারে মসজিদটি ১৬৭৬ সালে সুবাহদার শায়েস্তা খান কর্তৃক নির্মিত। বারবার সংস্কার ও সম্প্রসারণের ফলে মসজিদটি তার আদিরূপ হারিয়ে ফেলেছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি অর্ধ অষ্টকোণাকৃতির এবং বাকী দুটি আয়তাকার। মিহরাবগুলির আয়তাকার ফ্রেমের ওপর রয়েছে চিত্রিত শিখর নকশার একটি সারী। মসজিদটির মেঝেতে রয়েছে মার্বেল পাথর।
২১. ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার :
২০০০ সালে বিহার-ভবন মেরুল বাড্ডায় প্রতিষ্ঠিত হয়। বিহারে সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ড থেকে আনা দুটি বৌদ্ধমূর্তি। ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি মূর্তির উচ্চতা ৪৬, ওজন প্রায় সাড়ে ছয় মন এবং অষ্টধাতু নির্মিত অন্যটির উচ্চতা প্রায় সাড়ে সাত ফুট, ওজন ৭৭৭ কেজি। ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে প্রতিবছর কঠিন চীবরদানের শেষ শুক্রবার ঢাকা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারের কঠিন চীবরদান উদযাপন করা হয়। নিয়মিতভাবে বৃহত্তর আঙ্গিকে অনুষ্ঠিত হওয়া এ চীবর দানানুষ্ঠানে মহামান্য সংঘরাজ, সিনিয়র ভিক্ষু সংঘ, প্রধানমন্ত্রী বা সিনিয়র মন্ত্রীবর্গ সহকারে হাজার হাজার উপাসক উপাসিকা অংশ গ্রহণ করে থাকেন।
২২. আজিমপুর মসজিদ (দায়রা শরীফ ) :
ঢাকা শহরের আজিমপুর কবরস্থানের পাশে অবস্থিত। মসজিদটি জনৈক ফয়জুল্লাহ কর্তৃক ১৭৪৬ সালে নির্মিত হয়েছে। এটি একটি দ্বিতল ইমারত্ নীচের তলাটি ভল্টেট প্ল্যাটফর্ম। একক গম্বুজ এবং এর উভয় পার্শ্বে অর্ধগম্বুজ ভল্ট (ভল্ট সহযোগে নির্মিত এধরণের নিদর্শণসমূহের মধ্যে বাংলার স্থাপত্যে এখন পর্যন্ত এটা সর্বশেষ উদাহরণ) মসজিদটিকে অনন্যতা এনে দিয়েছে।
২৩. কসাইটুলী মসজিদ :
কসাইটুলীর এই মসজিদটির গায়ে সিরামিক টুকরোর মনোরম কাজ থাকায় স্থানীয়ভাবে “চিনিঠিকরি মসজিদ” নামে পরিচিত। ১৯১৯ সালে নির্মিত এই মসজিদটি স্থাপত্য শৈলির দিক থেকে ঢাকার আর দশটা মসজিদ হতে আলাদা। মসজিদটি বেশ কয়েকদফা সম্প্রসারণ ও সংস্কার করা হলেও এর আদি ভবনটি এখনও টিকে আছে।
গ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় :
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রমনায়। এটি বাংলাদেশের তথা পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালের ১লা জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। পূর্ববঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল একটি মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ সৃষ্টি করা। এই মুসলিম মধ্যবিত্ত সমাজই পরবর্তীতে পূর্ব বঙ্গের সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনে নেতৃত্ব দান করে। বঙ্গভঙ্গের সময় থেকে পূর্ব বঙ্গে মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণ শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তারই ফল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও শিক্ষাবিদ নানাপ্রকার প্রতিকুলতা অতিক্রম করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্দ্যেগের হাল ধরেন। অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।বাংলাদেশের সর্বপ্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৩ টি অনুষদে (কলা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, আইন অনুষদ, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, জীববিজ্ঞান অনুষদ, ফার্মেসি অনুষদ, ইঞ্জিনিযারিং এবং টেকনোলজী অনুষদ, আর্থ এন্ড এনভায়ারনমেন্টাল সায়েন্সেস অনুষদ, চারুকলা অনুষদ, চিকিৎসা অনুষদ, স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদ, শিক্ষা অনুষদ) ৭০ টি বিভাগ রয়েছে। এছাড়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে ১০ টি ইন্সটিটিউট এবং ৩৯ টি গবেষণা কেন্দ্র। ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্যে রয়েছে ২০ টি আবাসিক হল ও হোস্টেল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীকে কোনো না কোনো হলের সাথে আবাসিক/অনাবাসিক ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে যুক্ত থাকতে হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য ১৩ টি এবং ছাত্রীদের জন্য ৪ টি আবাসিক হল রয়েছে। এছাড়া চারুকলা অনুষদ ও ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউটের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা হোস্টেল এবং বিদেশী ছাত্রদের জন্য আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাস। বিশ্বদ্যিালয়ের প্রধান ইন্সটিটিউটসমূহ হচ্ছে- শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, পরিসংখ্যান গবেষণা ও শিক্ষণ ইন্সটিটিউট, ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, তথ্য প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট, লেদার প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ইন্সটিটিউট। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ যাবৎ মোট ২৭ জন উপাচার্য দায়িত্ব পালন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও ২৭ তম উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত ৪৭তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। সমাবর্তনে সম্মানসূচক ডক্টরেট প্রাপ্তদের প্রখ্যাত কয়েকজনের নামঃ বান কি মুন (ডক্টর অব ল'জ, ১৫ নভেম্বর, ২০১১); ইরিনা বোকোভা (ডক্টর অব ল'জ, ৯ মে, ২০১২), জগদীশ চন্দ্র বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, আবুল কাশেম ফজলুল হক, জামাল আব্দেল নাসের, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা. আবুল ফজল, কাজী মোতাহার হোসেন, আলী আকবর খান, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবদুস সালাম, অমর্ত্য সেন, শেখ হাসিনা, মাহাথির বিন মোহাম্মদ, মুহাম্মদ ইউনূস, রণজিত গুহ, প্যাসকেল ল্যামি (ডক্টর অব ল'জ), প্রণব মুখোপাধ্যায় (ডক্টর অব ল'জ)। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কৃতি ছাত্র: শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের জাতির পিতা,বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি; সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি; তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী; শেখ কামাল, মুক্তিযোদ্ধা, আবাহনী লিমিটেড (ঢাকা) এর প্রতিষ্ঠাতা; আব্দুল মতিন চৌধুরী, পদার্থবিজ্ঞানী, সদস্য, নোবেল কমিটি; এ কে এম সিদ্দিক, পদার্থবিজ্ঞানী, সদস্য, নোবেল কমিটি ১৯৮১; এম এ ওয়াজেদ মিয়া, পদার্থবিজ্ঞানী; খন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী, পদার্থবিজ্ঞানী; মোহাম্মদ আতাউল করিম, পদার্থবিজ্ঞানী; এ এম হারুন-অর-রশিদ, পদার্থবিজ্ঞানী; এম ইন্নাস আলী, পদার্থবিজ্ঞানী; সুলতানা নুরুন নাহার, পদার্থবিজ্ঞানী; ড. এ এফ এম ইউসুফ হায়দার, মনোনীত, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার ১৯৯৪; ড. শাহিদা রফিক, মনোনীত, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার২০০১; মুহম্মদ মুনিরুল ইসলাম, পদার্থবিজ্ঞান; ফজলুর রহমান খান, পুরকৌশলী, স্থপতি; মুহাম্মদ ইউনূস, অর্থনীতিবিদ; হাফিজ জি এ সিদ্দিকী, অর্থনীতিবিদ উপাচার্য, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়; আব্দুস সাত্তার খান, রসায়নবিজ্ঞানী; ফজলুল হালিম চৌধুরী, রসায়নবিজ্ঞানী, সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; আবুল হুসসাম, রসায়নবিজ্ঞানী; আবেদ চৌধুরী, জিনবিজ্ঞানী; শাহ মোহাম্মদ ফারুক; শাহ এ এম এস কিবরিয়া, অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশের সাবেক অর্থমন্ত্রী; শাহাবুদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি; মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, ইসলামী চিন্তাবিদ; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কথাসাহিত্যিক; বুদ্ধদেব বসু, বাঙালি কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং সম্পাদক; জাহানারা ইমাম, লেখিকা, কথাসাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী। হুমায়ূন আহমেদ, কথাসাহিত্যিক; হুমায়ূন আজাদ, কথাসাহিত্যিক; রফিক কায়সার, গবেষক, প্রাবন্ধিক; মুহম্মদ জাফর ইকবাল, লেখক। বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে কয়েকটি বিখ্যাত স্মৃতিস্তম্ভ ও ভাস্কর্য হচ্ছে - অপরাজেয় বাংলা; রাজু সন্ত্রাস বিরোধী ভাস্কর্য; স্বোপার্জিত স্বাধীনতা; দোয়েল চত্বর; তিন নেতার মাজার; ঢাকা গেইট; স্বাধীনতা সংগ্রাম; স্বামী বিবেকানন্দ; শহীদ মিনার; ঘৃণাস্তম্ভ; মধুদার ভাস্কর্য।
২. বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার :
দেশের ছাত্রসমাজ তথা জনসাধারণকে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তোলা এবং মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্র সম্পর্কে বিনোদনের মাধ্যমে ধারণা প্রদান করে সমাজ থেকে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস দূরীকরণের উদ্দেশ্যে অনানুষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশের প্রথম প্লানেটেরিয়াম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার’ স্থাপিত হয়। এটি উদ্বোধন করা হয় ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। রাজধানীর বিজয় সরণির মোড়ে বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার। এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ১৩০ কোটি টাকা। ৫ দশমিক ৪ একর জমির ওপর বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটার। নভোথিয়েটারের কেন্দ্রে ১৫০টি প্রজেক্টর ব্যবহার করে মাল্টিপল ইমেজের সমন্বয়ে একটি কৃত্রিম মহাকাশ তৈরি করা হয়েছে। নভোথিয়েটারে পাঁচটি লেভেল রয়েছে। এর মধ্যে মাটির ওপরে দুটি ও নিচে রয়েছে তিনটি লেভেল। ভবনটির দুটি ভূগর্ভস্থ ফ্লোরে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের ছবি ও জীবনবৃত্তান্ত রয়েছে। বঙ্গবন্ধু নভোথিয়েটারের অর্ধগোলাকৃতির ডোমে আছে বিমোহিত করার মতো প্রক্ষেপণ পদ্ধতির যন্ত্রপাতি। বিজ্ঞানসহায়ক এ নভোথিয়েটারে সম্পূর্ণ বিনোদনের মাধ্যমে মানুষকে বিজ্ঞানমনস্ক করে তোলার জন্য প্রদর্শিত হচ্ছে বিস্ময়কর ছবি। নভোথিয়েটারের অর্ধগোলাকৃতি কক্ষে থাকে বিমোহিত করার মতো পারফোরেটেড অ্যালুমিনিয়ামের পর্দা। এ পর্দায় চোখ রাখলে পুরো হলরুমের ছাদটাকেও মনে হয় সিনেমার অংশ। অ্যাস্ট্রোভিশন-৭০ প্রজেক্টর ফিল্মে গ্রহ-নক্ষত্র দেখার সময় দর্শকের অনুভূতিকে অনেক বেশি সজাগ করে তোলে। সাপ্তাহিক ছুটি বুধবার ও সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি ব্যতীত প্রতিদিন ৫টি প্রদর্শনী নিম্নোক্ত সময়সূচী অনুযায়ী পরিচালনা করা হয়। প্লানেটেরিয়াম শো এর জন্য জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ৫০.০০ (পঞ্চাশ) টাকা এবং ক্যাপসুল রাইড সিমুলেটরের জনপ্রতি টিকেটের মূল্য ২০.০০ (বিশ)।
৩. বাংলা একাডেমী :
১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পূর্ব নাম ছিল বর্ধমান হাউজ যা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হাউজ ছিল। বাংলা একাডেমীর প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। প্রতিবছর ভাষা শহীদদের স্মরণে একাডেমী চত্বরে বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়।
৪. শিশু একাডেমী :
ঐতিহাসিক কার্জন হলের উত্তর পাশে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্ত্বর থেকে পূর্ব দিকে হাইকোটের দিকে যাওয়ার পথে হাতের বাম পাশে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী অবস্থিত। শিশুদের জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শিশুদের জন্য নানামুখী পরিকল্পিত কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে সারাদেশে শিশু একাডেমীর চাহিদা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে দেশের সকল জেলায় এবং ৬টি উপজেলায় শিশু একাডেমীর অফিস রয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকে জাতীয় শিশু পুরষ্কার প্রতিযোগীতা দেশব্যাপী নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
৫. জাতীয় জাদুঘর :
বাংলাদেশ জাতীড জাদুঘর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে অবস্থিত দেশের প্রধান জাদুঘর। এটি মার্চ ২০, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং ৭ আগস্ট, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর তারিখে এটিকে জাতীয় জাদুঘরের মর্যাদা দেয়া হয়। জাদুঘরটি শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে পিজি হাসপাতাল, রমনা পার্ক ও চারুকলা ইন্সটিটিউটের পাশে অবস্থিত। এখানে নৃতত্ব, চারুকলা, ইতিহাস, প্রকৃতি এবং আধুনিক ও বিশ্ব-সভ্যতা- ইত্যাদি বিষয়ে আলাদা প্রদর্শনী রয়েছে। এছাড়া এখানে একটি সংরক্ষণাগারও রয়েছে। ব্রিটিশ সরকার এদেশে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে বঙ্গভঙ্গরদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে। শাহবাগ এলাকায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জন্য একটি অত্যাধুনিক বৃহদায়তন ভবনের উদ্বোধন করা হয় ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর। আট একর জমির ওপর নির্মিত চারতলা ভবনটির তিনটি তলা জুড়ে রয়েছে ৪৪টি গ্যালারি। জাতীয় জাদুঘরের বিভাগগুলো হচ্ছে - ইতিহাস ও ধ্রুপদী শিল্পকলা, জাতিতত্ত্ব ও অলঙ্করণ শিল্পকলা, সমকালীন শিল্পকলা ও বিশ্বসভ্যতা, প্রাকৃতিক ইতিহাস বিভাগ এবং রক্ষণ গবেষণাগার। জাদুঘরে প্রবেশের সময়সূচি: গ্রীষ্মকাল (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর): শনিবার-বুধবার (সকাল ১০:৩০- বিকাল ৫:৩০ পর্যন্ত) এবং শুক্রবার: বিকাল ৩:৩০- সন্ধ্যা ৭:৩০ পর্যন্ত । শীতকালীন (অক্টোবর-মার্চ): শনিবার-বুধবার (সকাল ৯:৩০- বিকাল ৫:৩০ পর্যন্ত) এবং শুক্রবার: বিকাল ৩:৩০- সন্ধ্যা ৭:৩০ পর্যন্ত ।
৬. পাবলিক লাইব্রেরী :
শিক্ষা ও জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশের লক্ষ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন লাইব্রেরী রয়েছে। যেমন - জাতীয় গ্রন্থ ভবন, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরী, সীমান্ত গণ গ্রন্থাগার, রামকৃষ্ণ মিশন গ্রন্থাগার, জাতীয় জাদুঘর লাইব্রেরী, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর লাইব্রেরী প্রভৃতি লাইব্রেরি উল্লেখযোগ্য। তন্মধ্যে কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। চারতলা বিশিষ্ট ভবনের ২য় ও ৩য় তলায় এই লাইব্রেরীটি অবস্থিত। এই গণ গ্রন্থাগারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহবাগ মোড়ের সন্নিকটে অবস্থিত, এর দক্ষিণ পাশে রয়েছে চারুকলা ইনষ্টিটিউট এবং উত্তর পাশে রয়েছে জাতীয় জাদুঘর ভবন। এই গ্রন্থাগারটিতে বিভিন্ন সমসাময়িক বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য বইও রয়েছে। যেমন - বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, অর্থনীতি, ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতি, উপন্যাস, আইন, ধর্মীয়, ভ্রমণ, নাটক, ছড়া, কবিতা, রান্না, চিকিৎসা, খেলাধুলা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, শিল্প, ম্যাগাজিন, জার্নাল ও ট্যাবলয়েড পত্রিকা। এছাড়াও জাগতিক নানা বিষয়ে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন ক্যাটাগরির বই সহ বার্ষিক সাধারন সভা, প্রতিবেদন, কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স ও সাময়িকী রয়েছে। এখানে সবমিলিয়ে পাঁচ লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। এই গ্রন্থাগারটিতে কোন ক্যাটালগ সিস্টেম নেই। তবে প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা সেলফ রয়েছে। যেখানে আলাদা আলাদা ভাবে বিষয়ভিত্তিক বই স্তরে স্তরে সাজানো রয়েছে। এছাড়া বিশেষ প্রয়োজনে সহায়তাদানের জন্য রয়েছে লাইব্রেরীন। জাতীয় গণ গ্রন্থাগারে প্রতিটি ফ্লোরে ৭০ টি করে সেলফ আছে।জাতীয় গণ গ্রন্থাগারে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ষান্মাসিক ও বাৎসরিক পত্রিকা ও সাময়িকী পাওয়া যায়। আরও রয়েছে চাকুরীর খবর ও কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স। এছাড়া এখানে পাঠকের প্রয়োজন ও চাহিদার দিক বিবেচনা করে পুরনো পত্রিকাও সংরক্ষণ করা হয়। শুক্রবার সাপ্তাহিক বন্ধ। এছাড়া সপ্তাহের অন্যান্য দিন সকাল ৯.০০ টা থেকে রাত ৮.৩০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে প্রতি শনিবার ২য় তলার অংশটুকু বন্ধ থাকে এবং ৩য় তলার অংশটুকু যথারীতি পাঠকদের জন্য খোলা থাকে।
৭. জাতীয় কবির সমাধি:
বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত তথা সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেমের কবি, সাম্যের কবি ও বিদ্রোহের কবি কাজী নজরুলের লেখনী ধুমকেতুর মত আঘাত হেনে আমাদের জাগিয়ে তুলেছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ২৪শে মে ১৮৯৯ সালে কাজী নজরুল জন্ম গ্রহণ করেন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারতসরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই কাছে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই";- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়। তাঁর জানাজার নামাযে ১০ হাজারের মত মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পর রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকা মন্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গনে নিয়ে যান। বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর দৃষ্টিনন্দন সমাধিস্থল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ-এর নিকট অবস্থিত। কবির সমাধিস্থলের পার্শ্বে একটি কবি নজরুল তথ্যকেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক দর্শণার্থী কবির সমাধিস্থল ভিজিট করেন।
৬. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর :
এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক দেশের প্রথম জাদুঘর। বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নিদর্শন ও স্মারকচিহ্নসমূহ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের স্থান। বেসরকারি উদ্যোগে আটজন ট্রাষ্টি কর্তৃক পরিচালিত এটি ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ ঢাকাস্থ সেগুনবাগিচার একটি পুরানো দ্বিতল বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে জাদুঘরের সীমিত পরিসরে প্রায় ১৪০০ স্মারক প্রদর্শিত হলেও সংগ্রহ ভান্ডারে জমা হয়েছে ১৫,০০০-এরও বেশি স্মারক। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিরপুরে মুসলিম বাজার ও জল্লাদখানা বধ্যভূমি খননের কাজ সম্পন্ন করে এবং পরে (২০০৮ সালে) জল্লাদখানা বধ্যভূমিতে একটি স্মৃতিপীঠ নির্মাণ করে। ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ এর অংশীদারিত্বে নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাস ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রদর্শনীর বিশেষ আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের রয়েছে গ্রন্থাগার ও তথ্য ভান্ডার এবং অডিও-ভিজ্যুয়াল সেন্টার। হৃদয় আলোড়িত করা জাদুঘর-প্রদর্শনী ও বিভিন্নমুখি কর্মতৎপরতা দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর পরিণত হয়েছে দেশে-বিদেশে নন্দিত প্রতিষ্ঠানে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস সম্পর্কে দেশের মানুষকে সচেতন করতে জাদুঘর নানা ধরণের কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। এটি প্রতিদিন সকাল সকাল ৯ টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্র্শার্ণাথীদের জন্য খোলা থাকে।
৭. শিল্পকলা একাডেমী :
শিল্পকলা একাডেমী বাংলাদেশে সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। এটি ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদের এক বিধিবলে ঢাকার রমনা থানার সেগুনবাগিচায় প্রতিষ্ঠিত হয়। চারুকলা, সঙ্গীত, নৃত্য ও নাট্যকলার চর্চা ও প্রসারই মূলত এ প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য। এখানে একটি অত্যাধুনিক নাট্যশালা রয়েছে। এখানে নাট্য প্রদর্শনসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
৮. নজরুল একাডেমী :
জাতীয় কবি নজরূর ইসলামের স্মৃতি রক্ষার্থে ১৯৮৫ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার ধানমন্ডিস্থ ২৮ নং রোডের কবিভবনে সরকার প্রতিষ্ঠিত একটি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। কবির রচনাবলী সম্পর্কে ব্যাপক অধ্যায়ন, গবেষণা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, সম্পাদনা ও প্রকাশ করা এ একাডেমীর মূল উদ্দেশ্য।
৯. জগন্নাথ বিশ্বদ্যিালয় :
১৮৮৪ সালে বালিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী জগন্নাথ কলেজ নির্মাণ করেন। বাহাদুর শাহ পার্কের নিকট অবস্থিত জগন্নাথ কলেজ এক সময় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সুসজ্জিত কলেজ ছিল। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালড বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার, সদরঘাটে অবস্থিত একটি স্বাডত্বশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালড। পূর্বতন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু। অধ্যাপক ড: এ. কে. এম. সিরাজুল ইসলাম খান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাশ করার মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি পুর্নাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপ নেয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অব্যবহিত প্রাক্তন নাম জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, তবে এটি জগন্নাথ কলেজ নামেই বিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ সময় জুড়ে পরিচিত ছিল। এটি ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী কলেজ। ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল নামে এর প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৭২ সালে এর নাম বদলে জগন্নাথ স্কুল করা হয়। বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল চৌধুরী তার বাবার নামে জগন্নাথ স্কুল নামকরন করেন । ১৮৮৪ সালে এটি একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর কলেজে ও ১৯০৮ সালে প্রথম শ্রেণীর কলেজে পরিণত হয়। এসময় এটিই ছিল ঢাকার উচ্চ শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হলে জগন্নাথ কলেজের স্নাতক কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির শিক্ষার্থী, শিক্ষক, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক, জার্নাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয় । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার সাজাতে জগন্নাথ কলেজ গ্রন্থাগারের ৫০ ভাগ বই দান করা হয়। জগন্নাথ কলেজে আই,এ, আই,এসসি, বি,এ (পাস) শ্রেণী ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হলেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তা বন্ধ করে দেয়া হযয় এবং ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয় জগন্নাথকে। পুরানো ঢাকার নারী শিক্ষায় বাধা দূর করতে ১৯৪২ সালে সহশিক্ষা চালু করা হয়। ১৯৪৮ সালে তা বন্ধ করে দেয়া হয়। পরে ১৯৪৯ সালে আবার এ কলেজে স্নাতক পাঠ্যক্রম শুরু হয়। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মাদ রফিকউদ্দিন (ভাষা শহীদ রফিক) আত্মত্যাগ করেন । ১৯৬৩ সালে অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান পুনরায় কো-এডুকেশন চালু করেন। ১৯৬৮ সালে এটিকে সরকারীকরণ করা হয়, কিন্তু পরের বছরেই আবার এটি বেসরকারী মর্যাদা লাভ করে। ২০০৫ সালে জাতীয় সংসদে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০০৫ পাশের মাধ্যমে এটি পুর্নাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ে রুপান্তরিত হয় । বর্তমানে মোট ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩১ টি বিভাগের ও একটি ইন্সিটিউটের মাধ্যমে এখানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে । ২০শে অক্টোবর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস।
১০. জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর :
ঢাকার আগারগাঁও প্রশাসনিক এলাকায় অবস্থিত। ভবনের নীচ তলায় মজার বিজ্ঞান, ভৌত বিজ্ঞান, মহাকাশ বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান শিরোনামের গ্যালারীগুলো বেশ আকর্ষণীয়। জাদুঘরে নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক চলচ্চিত্র ও ভিডিও প্রদর্শণীর আয়োজন করা হয়। এটি প্রতি সপ্তাহে শনিবার থেকে বুধবার পর্যন্ত ০৯-০৫ পর্যন্ত দর্শণার্থীদের খোলা থাকে।
১১. টাকা জাদুঘর :
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে দেশের প্রথম পূর্ণাঙ্গ টাকা জাদুঘর চালু হয়েছে। প্রাচীন উয়ারী বটেশ্বর আমল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সব ধরনের ধাতব ও কাগুজে মুদ্রা স্থান পেয়েছে এ জাদুঘরে। ২০১৩ সালে রাজধানীর মিরপুরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমীতে (বিবিটিএ) জাদুঘরটি স্থাপিত হয়েছে। প্রতি সপ্তাহের শনি থেকে বুধবার সকাল ১১টা থেকে বিকেল ৫টা এবং শুক্রবার বিকেল ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত জাদুঘর খোলা থাকে।
ঘ) বিনোদনমূলক :
পর্যটন আকর্ষণ:
১. রমনা পার্ক :
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর শাহবাগ থেকে ইডেন বিল্ডিং (সচিবালয়) পর্যন্ত নতুন একটি রাস্তা করা হয় এবং এই রাস্তার পূর্বদিকের অংশে রমনা পার্ক নামে একটি চমৎকার বাগান গড়ে তোলা হয়। এখানে প্রতিদিন শত শত লোক বেড়াতে আসে। পার্কের ভিতর স্বচ্ছ জলের সুন্দর লেক আছে। রমনা পর্কের বটমূলে ১লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ উদযাপনের প্রধান আয়েজন করা হয় এবং এদিন পার্ক এবং পর্কের বাইরে মেলা বসে। ঐদিন পার্কে লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামে।
২. বলধা গার্ডেন :
ঢাকা শহরের ওয়ারী এলাকায় অবস্থিত একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন। ভাওয়াল জমিদার নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী ১৯০৯ সালে অন্যতম প্রাচীন এই বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাগানটি সিবিলি ও সাইকি নামে দুইটি অংশে বিভক্ত । এর প্রতিষ্ঠাতা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে দুর্লভ প্রজাতির গাছপালা এনে বাগানটিকে সমৃদ্ধ করেছেন। সব মিলিয়ে এখানে ৬৭২ প্রজাতির প্রায় ১৫,০০০টি সংগ্রহ দেখতে পাওয়া যায় অনেকগুলিই বিদেশী ও দুশ্চপ্রাপ্য। বাগানটি সিবিলি অংশে একটি সূর্যঘড়ি রয়েছে। বাগানের ফুলের শোভা উপভোগ করার জন্য আনন্দভবন নামে একটি বিশ্রামাগার তথা অ্যাম্ফিথিয়েটার ও দুইটি মনোরম পুকুর রয়েছে। এটি প্রতিদিন সকাল ৮:০০ টা থেকে বিকাল ৫:০০ টা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে দুপুর ১২ টা থেকে দুপুর ২ টা পর্যন্ত মধ্যাহ্ন বিরতি থাকে।
৩. বোটানিকাল গার্ডেন :
ঢাকার মিরপুরে অবস্থিত বোটানিকাল গার্ডেন। প্রায় ২.৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনবিমিষ্ট এই উদ্যানটিতে রয়েছে প্রায় আট হাজার প্রজাতির গাছ। এখানে লিলি পন্ড এবং লোটাস পন্ড নামে ০৬টি সুন্দর লেক রয়েছে। আরো রয়েছে বিশাল দুটি নার্সারি, টিস্যু কালচার রিসার্চ সেন্টার, অর্কিড হাউজ, ক্যকটাস হাউজ ইত্যাদি। পুরো বাগানের সৌন্দর্য অবলোকনের জন্য রয়েছে দুটি টাওয়ার। লেকে শীতকালে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। এটি সপ্তাহের সাতদিনই সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রকৃতি প্রেমিরা এখানে প্রকৃতির সান্নিধ্য উপভোগ করে।
৪. ধানমন্ডি লেক :
ঢাকা সিটির মধ্যস্থলে ধানমন্ডিতে অবস্থিত ভ্রমণ পিপাসুদের আনন্দ দান করে থাকে। ধানমন্ডি লেকের কোলঘেষে নির্মাণ করা হয়েছে রবীন্দ্র সরোবর। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে।
৫. চিড়িয়াখানা (মিরপুর):
ঢাকার মিরপুরে মোট ১৮৬ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এ চিড়িয়াখানায় রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, সিংহ, অজগর, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণ, ময়না, হায়েনা, জিরাফ গন্ডার, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ, পাখি ইত্যাদিসহ মোট ১৪০০ রকম পশুপাখি ও জীবজন্তু রয়েছে। ঢাকার মিরপুরে স্থাপিত বাংলাদেশের জাতীড চিড়িয়াখানা। এটি বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৫০ সালে হাইকোর্ট চত্বরে জীবজন্তুর প্রদর্শনশালা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় চিড়িয়াখানাটি। পরবর্তীকালে ১৯৭৪ সালে বর্তমান অবস্থানে স্থানান্তরিত হয় এটি। চিড়িয়াখানাটি উদ্বোধন ও সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুন। বছরে প্রায় ৩০ লক্ষ দর্শনার্থী ঢাকা চিডিয়াখানা পরিদর্শন করে থাকেন। চিড়িয়াখানার চত্বরে ১৩ হেক্টরের দুটি লেক আছে। চিড়িয়াখানা তথ্যকেন্দ্র হতে প্রাপ্ত তথ্য হতে জানা যায়, বর্তমানে ঢাকা চিড়িয়াখানায় ১৯১ প্রজাতির ২১৫০টি প্রাণী রয়েছে। খোলা-বন্ধের সময়সূচী: গ্রীষ্মকালীন সময় (১ লা এপ্রিল থেকে ৩০ শে েেস্প্টম্বর): সকাল ৯ টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা। শীতকালীন সময় (১লা অক্টোবর থেকে ৩১ শে মার্চ): সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা।
৬. শিশুপার্ক :
রমনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিশুপার্ক অবস্থিত। এখানে শিশুদের অনেক রাইডস আছে। উল্লেখ্য স্বল্পমূল্যে শিশুরা এগুলো উপভোগ করতে পারে। যান্ত্রিক নগরী ঢাকাতে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অন্যতম বিনোদনের স্থান এই শিশু পার্ক। নামে শিশু পার্ক হলেও সকল বয়সের মানুষের জন্য এই পার্কটি উন্মুক্ত। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন এই পার্কটি নির্মাণ করে। পরবর্র্তীতে পার্কটির তত্ত্বাবধান কাজ ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের হাতে চলে যায়। খোলা- বন্ধের সময়সূচী: অক্টোবর থেকে মার্চ: সোমবার - শনিবার ( দুপুর ১.০০ টা থেকে সন্ধ্যা ৭.০০ টা পর্যন্ত)।
সাপ্তাহিক বন্ধ: রোববার; বুধবার (ছিন্নমূল ও দুস্থ শিশুদের জন্য): দুপুর ১.৩০ টা থেকে বিকেল ৪.০০ টা পর্যন্ত।
এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর: সোমবার- শনিবার: দুপুর ২.০০ টা থেকে রাত ৮.০০ টা পর্যন্ত; বুধবার (ছিন্নমূল ও দুস্থ শিশুদের জন্য): দুপুর ২.০০ টা থেকে বিকেল ৪.৩০ টা পর্যন্ত।
৭. চন্দ্রিমা উদ্যান :
চন্দ্রিমা উদ্যান জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় ক্রিসেন্ট লেকের পাশে অবস্থিত। এখানে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারও রয়েছে। এলাকাটি খুব সুন্দর করে সাজান। প্রতিদিন এখানে অসংখ্য দর্শণার্থীর আগমন ঘটে।
৮. হাতিরঝিল প্রকল্প - ঢাকার কন্ঠে হীরের হার :
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা মহানগরীর উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ মাইল ফলক হিসেবে বাস্তবায়িত হয়েছে হাতিরঝিল প্রকল্প । কেউ কেউ এই প্রকল্পটিকে ঢাকার কন্ঠে হীরের হার নামে অভিহিত করেছেন। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে কাজী নজরুল ইসলাম রোড থেকে রামপুরা ব্রীজ পর্যন্ত এর বিস্তার। দুইশত নিরানব্বই একর জলাভূমি ও বেদখলকৃত জমি দখল মুক্ত করে বাস্তবায়িত হয়েছে প্রকল্পটি । শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রলম্বিত স্বচ্ছ লেক, আঠার কিলোমিটার রোড ও স্টর্ম স্যূয়ার এবং চারটি সুদৃশ্য নান্দনিক ব্রীজে সাজানো প্রকল্প এলাকাটি জটপীড়িত যান চলাচল ব্যবস্থাকে গতিশীল করেছে। শুধু তাই না এটি প্রকল্প ও সংলগ্ন এলাকার রাজধানীপযোগী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। এর আঠার কিলোমিটার রোডে স্থাপিত হয়েছে চোখ জুড়ানো আলোকায়ন ব্যবস্থা। যা রাতের বেলা এলাকাটিকে করে তুলে নয়নাভিরাম অপরূপা। এর নান্দনিক দিকগুলির জন্যে স্থানটি বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ইতোমধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
৯. শ্যামলী শিশুমেলা :
শ্যামলী থেকে আগারগাঁওগামী রাস্তার মোড়ে এর অবস্থান। এর পরিসর ছোট। এটি একটি বেসরকারী আয়োজন। এখানে শিশুদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন প্রকার রাইডসসহ নানা ধরনের ব্যবস্থা আছে। এটি প্রতিদিন বিকাল ৩ টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সকলের জন্য খোলা থাকে।
১০. নিউমার্কেট :
আজিমপুর এবং ধানমন্ডি এলাকাসমূহে বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরের নতুন জনবসতির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৫২-৫৪ সালে নির্মিত একটি বিপণী কেন্দ্র। পর্যায়ক্রমে এটি ঢাকার বাইরের ক্রেতাদেরও আকর্ষণ করে। মার্কেটটিতে বিভিন্ন রকমের দোকান রয়েছে এবং বাজার করতে আসা ক্রেতারা এখানে তাদের চাহিদা অনুযায়ী প্রায় সব জিনিস-পত্রই পেয়ে থাকে।
ঙ) উৎসব সম্পর্কিত :
পর্যটন আকর্ষণ:
১. রমনা মটমূলের পহেলা বৈশাখ উদযাপনঃ
পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ (বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস বৈশাখের ১ তারিখ) বাংলা সনের প্রথম দিন, তথা বাংলা নববর্ষ। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নববর্ষ হিসেবে বিশেষ উৎসবের সাথে পালিত হয়। ত্রিপুরায় বসবাসরত বাঙালিরাও এই উৎসবে অংশ নেয়। সে হিসেবে এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের সকল বাঙালি এ দিনে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়, ভুলে যাবার চেষ্টা করে অতীত বছরের সকল দুঃখ-গ্লানি। সবার কামনা থাকে যেন নতুন বছরটি সমৃদ্ধ ও সুখময় হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা একে নতুনভাবে ব্যবসা শুরু করার উপলক্ষ্য হিসেবে বরণ করে নেয়। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৪ই এপ্রিল অথবা ১৫ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালিত হয়। আধুনিক বা প্রাচীন যে কোন পঞ্জিকাতেই এই বিষয়ে মিল রয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৪ই এপ্রিল এই উৎসব পালিত হয়। বাংলা একাডেমী কর্তৃক নির্ধারিত আধুনিক পঞ্জিকা অনুসারে এই দিন নির্দিষ্ট করা হয়েছে। পহেলা বৈশাখ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পীরা রমনা বটমূলে সম্মিলত কন্ঠে গান গেয়ে নতুন বছরকে আহবান জানান। ১৯৬০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠির নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সাল থেকে ছায়ানটের এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সূচনা। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায গ্রামীণ জীবণ এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে।
২. রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তীঃ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের দিকপাল। তাঁদের রচনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। । রবীন্দ্রনাথ মানুষের জন্য গল্প-কবিতা, নাটক,-উপন্যাস ইত্যাদি রচনা করে বিশ্ব কবি নির্বাচিত হয়ে ‘নোবেল পুরস্কার’ অর্জন করে বিশ্বের দরবারে আমাদের বাংলা ভাষাকে পরিচিত করেছেন এবং আমাদের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। নজরুল তাঁর লেখনির দ্বারা আমারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছি, হয়েছি স্বাধীনচেতা। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল আমাদের আলোর পথ দেখায়। তাঁদের অমর সৃষ্টিগুলো নতুন প্রজন্মের মাঝে চর্চার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সারা বাংলাদেশে ২০১৩ সালে সরকারী উদ্যোগে বর্ষব্যাপী পালিত হলো রবীন্দ্র-নজরুল জন্ম জয়ন্তী উৎসব। রাজধানী ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে আলোচনা সভা, আবৃত্তি, রবীন্দ্র ও নজরুল সঙ্গীত প্রতিযোগিতাসহ মনোমুগ্ধকর ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং জাতীয় কবি কাজী নজররুল ইসলামের জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে দেশের সরকারি এবং বেসরকারি ইলেকট্রনিক্স এবং প্রিন্ট মিডিয়াগুলোও বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছে।
৩. বর্ষারবণ:
বাংলাদেশে আষাঢের প্রথম দিন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাসমূহে বর্ষা ঋতু-কে বিভিন্ন গানের মাধ্যমে বরণ করে নেয়া হয়। আর এ বর্ষা ঋতু-কে কেন্দ্র করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আমাতের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক গান এবং কবিতা রচনা করেছেন।
৪. জন্মাষ্টমী: জাতির শান্তিকামনায় প্রতিবছর ঢাকায় পালিত হয়ে আসছে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী তিথি। দিবসটি পালন উপলক্ষে সারাদেশে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্র বের করা হয়। পরে বিভিন্ন মন্দির প্রাঙ্গণে আয়োজন করা হয় আলোচনা সভার। এসব সভায় শ্রীকৃষ্ণের দেখানো শান্তির পথে চলার অঙ্গীকার করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা।
৫. বসন্ত উৎসব :
উৎসব-প্রিয় বাঙালীর এক প্রাণের উৎসব হচ্ছে বসন্ত-উৎসব। ইংরেজি ক্যালেন্ডারে ১৪ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে আমাদের বসন্ত ঋতুর প্রথম দিন। বাংলাদেশের ঋতুচক্রকে ঘিরে কত উৎসব, কত মেলা! তাই গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত ঋতুকে ঘিরে নানা উৎসব ও অনুষ্ঠানের আয়োজন। আমাদের জীবনে একটা ভিন্নমাত্রা নিয়ে আসে এ উৎসব। শীতের রুক্ষ্ম, শুষ্ক ও বিবর্ণ প্রকৃতির বুকে সজীবতার পরশ। দখিনা মাতাল সমীরণে প্রস্ফুটিত ফুলের মিষ্টি মধুর সুবাস, বিহঙ্গের কূজন, মধুপের গুঞ্জনে বসন্ত অপূর্ব বর্ণিল হয়ে ওঠে। বনে বনে বিচিত্র ফুলের বর্ণে, গন্ধে ও রূপে প্রকৃতি অপরূপা। বসন্ত ঋতু জীবন ও যৌবনের জয়গানে মুখর। চারুকলা, ছায়ানট, বাংলা একাডেমী, রমনার বটমূলে ও শান্তি-নিকেতনের বৃক্ষকুঞ্জে আয়োজিত হয় ঋতুবরণ অনুষ্ঠান। গানে, কবিতায়, নৃত্যে হিন্দোলিত হয় আমাদের হৃদয়। তখন বঙ্গললনার পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি, কপোলে বড় লাল টিপ, খোঁপায় লাল ও হলুদ ফুল-মালা। আমাদের সংস্কৃতির এ এক অপরূপ রূপ। আকাশে বাতাসে তারই প্রতিধ্বনি। প্রতি ঋতু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সরস ও জীবন্ত হয়ে ওঠে। বসন্ত আমাদের কাছে শুধু প্রাণেরই উৎসব নয়, ফাল্গুনের আগুনঝরা, রক্তলাল বসন্ত এত আলো, হাসি, গান, সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি বিষাদের রাগিণী যেন সমান্তরালভাবে আমাদের চেতনায় প্রবাহিত। আমাদের কাছে ফাল্গুন আসে রক্তস্নাত ৫২'র ভাষা-আন্দোলনের প্রতীক হয়ে। তাই বসন্তের আবেদন আমাদের হৃদয়ের গভীরে। চেতনার মর্মমূলে।
৬. পিঠা উৎসব :
বাংলার পিঠার ঐতিহ্য বহু পুরানো। ঋতুর সাথে সাথে বদলায় মানুষরে জীবন ধারণ প্রক্রিয়া, আর তার সাথে সাথে সময়ের নিমিষেই চাহদিা বাড়ছে বাংলার পিঠার। কাল, সময়, গল্প, পাড়ি দিতে হয় এই পিঠা শিল্পের ঐতিহ্য। তবে মূলত শীতকালইে পিঠার আসল স্বাদ খুঁজে পায় বাঙ্গালী। নবান্নরে উৎসব কিংবা পৌষ সংক্রান্তি পালনে যুগযুগ ধরে পিঠা বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির ঐতহ্য হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। নবান্ন এলেই গ্রাম বাংলায় পিঠাপুলি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। ঘরে নতুন ধানের চাল। আর সে চাল থেেক গুড়ো কুটে নানী, দাদী, মা খালারা সমস্ত বিকাল শেষে সন্ধ্যা পার করে দেন পরিবার-পরিজনদের পিঠা আপ্যায়নে। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের উদ্যোগে বিভিন্ন বছরে পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
চ) নৌ-পর্যটন :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. বুড়িগঙ্গা নদী :
বুড়িগঙ্গা গঙ্গার শাখা নদী। এটি ঢাকা শহরের প্রাণ। ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে বুড়িগঙ্গা নদী হতে পারে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। এ নদী নৌ-বিহারের উপযুক্ত।
ছ) গ্রামীণ, কৃষি ও স্থানীয় ঐতিহ্য :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. পুরোনো ঢাকার তেহারী :
ভোজন রসিকদের মনে তেহারী একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পুরনো ঢাকার তেহারীর স্বাদ গ্রহন করেছেন, অথচ জিভে পানি আসেনি এমন লোক পাওয়া কঠিন। পোলাওয়ের চাল এবং মাংস (গরু/খাসি) এর প্রধান উপকরণ। ঝোলমুক্তভাবে ছোট ছোট মাংসের টুকরো পোলাওয়ের চালের উপর ছড়িয়ে দিয়ে তেহারী রান্না করা হয়। পুরনো ঢাকার ভাল মানের তেহারী পাওয়া যায় এমন কয়েকটি রেষ্টুরেন্ট যেমন - রয়েল রেষ্টুরেন্ট, হাজীর বিরিয়ানী, নান্না মিয়ার বিরিয়ানী, ফকরুদ্দিন বিরিয়ানী, হানিফ বিরিয়ানী, মামুন বিরিয়ানী, তৃপ্তি বিরিয়ানী, আল্লাহর দান তেহারী হাউস, অলির তেহারী, ছন ঘরের তেহারী অন্যতম। এছাড়া ঢাকার চকবাজার এবং নীলক্ষত বই মার্কেটে ভাল তেহারী পাওয়া যায়। তেহারী প্রস্তুতের উপকরণসমূহের মধ্যে রয়েছে খাসির মাংস বা গরুর মাংস, পেঁয়াজ কুচি, রসুন বাটা, দারুচিনি, টকদই, কাঁচা মরিচ, আদা বাটা, দুধ, গোল মরিচ গুড়া, এলাচ, ঘি বা সয়াবিন বা সরিষার তেল। রেষ্টুরেন্টগুলোতে তেহারীর সাথে সালাদ, বোরহানী, পেয়াজ, কাঁচামরিচ এবং শসা পরিবেশন করা হয়। এখানে ভাল মানের তেহারী পাওয়া যায় বলে ঢাকার অন্যান্য প্রান্তের লোকজনও তেহারীর স্বাদ নিতে পুরনো ঢাকায় ভিড় জমান।
২. বাকরখানি :
মুঘল আমলের খাবারগুলো মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত বাকরখানি রুটি। লোকমুখে প্রচিলত আছে আগা বাকেরের নাম অনুসারে এই রুটি তৈরী হয়েছে। এই রুটি আফগানিস্তান ও রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় পাওয়া যায়। প্রকৃত বাকরখানি খাঁটি ময়দা, ঘি, মাওয়ার খামির ও দুধ দিয়ে তৈরী করা হয়। ময়দা, সাথে সামান্য খাবার সোডা, ডালডা, একটি তন্দুর এবং এর মাঝে উত্তাপ ছড়ানো জ্বলন্ত কয়লা। ব্যস, হয়ে গেল যোগান। প্রথমে একটি বিশেষ প্রক্রিয়ায় ময়দা, সামান্য পানি এবং ডালডার সমন্বয়ে খামীর তৈরী করা হয়। এবার তৈরীকৃত খামীর থেকে কেটে ছোট ছোট গোলাকার কোয়া তৈরী করা হয়। এবার কোয়াটি বেলুনের সাহায্যে পাটার উপরে সামন্তরাল ভাবে ছোট গোলাকার কাঁচা রুটি তৈরী করা হয়। কাঁচা রুটির মাঝখানে ছুড়ি দিয়ে লম্বা করে তিনটি দাগ কেটে দেওয়া হয়। এবার এর এক পাশে পানির সামান্য প্রলেপ দিয়ে তন্দুরের দেয়ালে আটকিয়ে দেয়া হয়। ৫ থেকে ৭ মিনিট অপেক্ষা করুন। তৈরী হয়ে গেল বাকরখানি রুটি। আবার ঘৃত দিয়েও বিশেষ যত্নের সাথে এই রুটি তৈরী করা হয়ে থাকে। বাকরখানি রুটি চায়ের সাথে খাওয়ার প্রচলন বেশী। এছাড়াও মাংসের সাথে, হোক সে গরু বা খাশীর অথবা মুরগীর, সংগে বাকরখানি রুটি এ যেন সোনায় সোহাগা। ক্ষীর এবং পায়েশের সাথেও এই রুটি পরিবেশন করা হয়ে থাকে। ঢাকার সোয়ারীঘাট থেকে ট্রলারে করে জিঞ্জিরার পরে বরিশুর নামে একটি এলাকার বাকরখানি রুটির বেশ নাম ডাক সারা ঢাকা জুড়ে। পুরনো ঢাকার লালবাগ, নাজিমুদ্দিন রোড, বক্সিবাজার এবং চাঁনখারপুল এলাকা বাকরখানি রুটি তৈরীর জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও জিন্দাবাহার, কসাইটুলী, নাজিরা বাজার, নবাব বাড়ী, আওলাদ হোসেন লেন, নবরায় লেন, নারিন্দা ও সূত্রাপুরসহ ঢাকার নাম না জানা অলিতে গলিতে বাকরখানি রুটির দোকান রয়েছে।
৩. ঢাকাইয়া খানা :
৪০০ বছরেরও বেশি পুরোনা আমাদের এই ঢাকা শহর। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের শাসক শাসন করেছেন এ শহর। মসলিন বাণিজ্যসহ বিভিন্ন দিক থেকে সমৃদ্ধ ঢাকা কেবল সমরনায়কদের আকর্ষণ করেনি, ব্যবসার মাধ্যমে ভাগ্য ফেরাতে কিংবা ধর্মপ্রচার করতেও এসেছেন বহু মানুষ। এত মানুষের আনাগোনা ঢাকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও পরিবর্তন এনেছে। কিছু খাবার অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছে, ধীরে ধীরে ঢাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। শুধু ঢাকাবাসীই নন, ঢাকার বাইরের লোকেরাও ঢাকা এলে এসব খাবারের স্বাদ নেবার চেষ্টা করেন। এসব ঐতিহ্যবাহী কিছু খাবারের আবার অদ্ভুত নামও রয়েছে, যেমন- জগা খিচুরি, বড় বাপের পোলায় খায়, পাগলার গেলাসী, খেতা পুরি। ঢাকার অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে রয়েছে- হাজির বিরিয়ানী, নান্না মিয়ার মোরগ পোলাও, রয়েলের বোল পোলাও, নিরব হোটেলের নানান ভাজি-ভর্তা, বাকরখানি, আনন্দ বেকারী, চকবাজারের ইফতার সামগ্রী, নবাবপুরের সুতলী কাবাব, ইরানী কাবাব, দম কাবাব, স্টার হোটেলে কাচ্চি বিরিয়ানী, কাবাব, খাসীর লেগ রোস্ট, টানা পরোটা, বুন্দিয়া, নূরানী লাচ্ছি, বিউটি লাচ্ছি, এবং লাবাং। একবার স্বাদ নিয়ে মানুষ বারবার ফিরছেন এসব খাবারের টানে। বিশেষ করে প্রতিবছর রমজান মাসে চকবাজারে উপচে পড়া ভিড় থাকে ক্রেতাদের। ঢাকার এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিদিন চার হাজারের বেশি মানুষ এই মার্কেটে আসেন ইফতার সামগ্রী কিনতে। এসব খাবারের অনেকগুলো আবার বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ খাবার তৈরির দক্ষ লোকের শূন্যস্থান অনেকসময় ঠিকভাবে পূরণ হচ্ছে না। তরুণদের মধ্যে পশ্চিমা ঢঙের ফাস্টফুড কালচার জনপ্রিয় হলেও ঢাকার খাবার ঠিকই তার স্থান ধরে রাখতে পেরেছে।
সাভার উপজেলা :
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. জাতীয় স্মৃতিসৌধ :
জাতীয় স্মৃতিসৌধ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নিবেদিত একটি স্মারক স্থাপনা। এটি সাভারে অবস্থিত। এর নকশা প্রণয়ন করেছেন স্থপতি সৈয়দ মাইনুল হোসেন। বিদেশী রাষ্ট্রনায়করা সরকারী বাংলাদেশে সফরে আগমন করলে এই স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন রাষ্ট্রাচারের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে নবীনগরে এই স্মৃতিসৌধের শিলান্যাস করেন। বাংলাদেশ সফরকারী বিদেশী রাষ্ট্র প্রধানগণের নিজ হাতে এখানে স্মারক বৃক্ষরোপণ করে থাকেন। স্মৃতিসৌধের মিনার ব্যতিত প্রকল্পটির মহা-পরিকল্পনা ও নৈসর্গিক পরিকল্পনাসহ অন্য সকল নির্মাণ কাজের স্থাপত্য নকশা প্রণয়ন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্থপত্য অধিদপ্তর। নির্মাণ কাজের গোড়াপত্তন হয় ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে এবং শেষ হয় ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দের মাসে। ১৯৭১'র ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। এই সৃতিসৌধটি বাংলার আপামর জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ লডাইয়ের স্মরণে নিবেদিত এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধার উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। সৃতিস্তম্ভ এবং এর প্রাঙ্গণের আয়তন ৩৪ হেক্টর (৮৪ একর)। এ ছাড়াও রয়েছে একে পরিবেষ্টনকারী আরও ১০ হেক্টর(২৪ একর)এলাকা নিয়ে বৃক্ষরাজি পরিপূরণ একটি সবুজ বলয়। এই সৃতিসৌধ সকল দেশ প্রেমিক নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় ও সাফল্যের যুগলবন্দি রচনা করেছে। সাতটি ত্রিভুজ আকৃতি মিনারের শিখর দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সাতটি পর্যায়ের প্রতিটি এক ভাবব্যঞ্জনাতে প্রবাহিত হচ্ছে। এই সাতটি পর্যায়ের প্রতিটি সূচিত হয় বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। পরবর্তীতে চুয়ান্ন, আটান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি ও উনসত্তরের'র গণ-অভ্যথানের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। মিনারটি ৪৫ মিটার (১৫০.০০ ফুট) উঁচু এবং জাতীয় শহীদ সৃতিসৌধ প্রাঙ্গণের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিন্দুতে অবস্থিত। মিনার ঘিরে আছে কৃত্রিম হ্রদ এবং মনোরম বাগান। সৃতিসৌধ চত্বরে আছে মাতৃভূমির জন্য আত্মোৎসর্গকারী অজ্ঞাতনামা শহীদের দশটি গণ সমাধি। সৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে আরও রয়েছে উন্মুক্ত মঞ্চ,অভ্যর্থনা কক্ষ, মসজিদ, হেলিপ্যাড এবং বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন কর্তৃক পরিচালিত ’জয় রেস্তোরাঁ’।
২. বিরুলিয়া সাহা বাড়ি :
বিরুলিয়া সাহা বাড়ি সাভারের অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। এ বাড়িতে রয়েছে ইট-সুরকির তৈরী তিনটি প্রাসাদ। দোতালাকারে তৈরী প্রাসাদগুলোর প্রধান আকর্ষণ বড় বড় করিনথীয় থাম, খিলানাকার দরজা ও জানালা, রঙিন কাচের টাইপেনাম ঝুলে পড়া সেড প্রভৃতি দর্শনাথীদের দৃষ্টি আর্কষণ করে।
৩. রাজাশন ঢিবি :
সাভার হতে ৫ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ও ঢাকা হতে ২১ মাইল দূরে নান্নার ও সুয়াপুর গ্রামদ্বয়ের মধ্যে অবস্থিত প্রায় অর্ধ মাইল ব্যাপী মৃত্তিকা স্তুপ রাজাশনের ভিটা নামে পরিচিত। অনেকের মতে ইহা সুপ্রসিদ্ধ বজ্রাসন বিহারের ধ্বংসাবশেষ। প্রায় ১২ বছর ধরে স্বনামধন্য অতীশ দীপঙ্কর এই বিহারে শিক্ষা লাভ করেন।
৪. রাজা হরিশচন্দ্রের প্রাসাদ :
রাজা হরিশচন্দ্র পাল মেদিনীপুর অঞ্চল থেকে সাভারে এসে রাজ্য স্থাপন করেন। সাভারের পূর্ব দিকে বালীমহর নামক স্থানে তাঁর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। তাঁর দূর্গটি এখন “কোঠা বাড়ি’ নামে একটি মৃত্তিকা স্তুপ।
খ) ধর্মীয় :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. ক্যাথলিক গির্জা :
সাভার বাজার বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন খৃষ্টানদের ধর্মীয় উপাসনালয় ক্যাথলিক গীর্জা । এখানে প্রতি রবিবার, বড়দিনসহ অন্যান্য দিনে উপাসনার উদ্দেশ্যে বিপুল সংখ্যক খৃষ্ট ধর্ম অনুসারীগণ সমাবেত হয়ে থাকেন।
২. কালী মন্দির :
সাভার বাজার সংলগ্ন স্থানে কালী মন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে কালী পূজা ছাড়াও অন্যান্য দিনে হিন্দু ধর্মাবলম্বীগণ পূজা আর্চণা করার উদ্দেশ্যে এখানে আসেন।
গ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় :
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের একটি অন্যতম আবাসিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকার অদূরে সাভার এলাকায় প্রায় ৬৯৭.৫৬ একর এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি অবস্থিত। ১৯৭০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলেও সম্পূর্ণরূপে এর কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৭২ সালে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ও মানবিকী, গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক, সমাজ বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ রয়েছে। ১৯৭০ সালে জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে এটির নামকরণ করা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। ঢাকা শহরের মুঘল আমলের নাম "জাহাঙ্গীরনগর" থেকে এই নামকরন করা হয় । প্রথম ব্যাচে ১৫০ জন ছাত্র নিয়ে ৪ টি বিভাগ চালু হয়। বিভাগগুলো হচ্ছে অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত এবং পরিসংখ্যান। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উদ্বোধন করেন । তার আগে ১৯৭০ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য নিযুক্ত হন অধ্যাপক মফিজ উদ্দিন। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রখ্যাত কবি সৈয়দ আলী আহসান, লোকসাহিত্যবিদ মজহারুল ইসলাম, লেখক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, আ ফ ম কামালউদ্দিন, আমিরুল ইসলাম চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ আব্দুল বায়েস, আলাউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মুস্তাহিদুর রহমান প্রমুখ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো শিক্ষকতা করেছেন অধ্যাপক সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়, লেখক হায়াত্ মামুদ, লেখক হুমায়ুন আজাদ, নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি মোহাম্মদ রফিক (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত), অধ্যাপক মুস্তাফা নূরুল ইসলাম, আবু রুশদ মতিনউদ্দিন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দিলারা চৌধুরী, ইতিহাসবিদ বজলুর রহমান খান প্রমুখ। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে পুরোদমে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ক্রমে বিভাগের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাংলাদেশের প্রথম নৃবিজ্ঞান ও ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলাদেশের একমাত্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুরুতে দুইটি অনুষদ নিয়ে যাত্রা করলেও পরের বছর কলা ও মানবিকী অনুষদ খোলা হয়। বর্তমানে অনুষদ ৫ টি। বাংলাদেশের স্বায়ত্বশাসিত প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ছাত্রসংখ্যায় এটি ক্ষুদ্রতম। কিন্তু বিভিন্ন জাতীয় ও অভ্যন্তরীন আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিদ্যায়তনিক পরিসরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কর্মকান্ড উল্লেখযোগ্য। মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত সমৃদ্ধ। এছাড়া উয়ারী ও বটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের খননকার্য, দেশীয় নাট্যচর্চায় নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অবদান, বিদ্যায়তনিক নৃবিজ্ঞান চর্চায় নৃবিজ্ঞান বিভাগের পথপ্রদর্শন সুবিদিত। ইতিহাস বিভাগের "ক্লিও", নৃবিজ্ঞান বিভাগের "নৃবিজ্ঞান পত্রিকা", বাংলা বিভাগের "ভাষা ও সাহিত্য পত্র", ইংরেজি বিভাগের "হারভেস্ট", দর্শন বিভাগের "কপুলা"সহ ২৬ টি বিভাগের ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশনা গবেষণায় উল্লেখযোগ্য স্বাক্ষর রেখেছে। উত্তর-পূর্বে সাভার সেনানিবাস, উত্তরে জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং পূর্বে একটি বৃহৎ ডেইরী ফার্ম অবস্থিত। প্রায় সমতল, বিস্তীর্ণ ক্যাম্পাস এলাকার মাঝে মাঝে উচুঁনিচু সামান্য ঢাল ও সবুজের সমারোহ মনোমুগ্ধকর। চারপাশে আছে ছোট-বড় অসংখ্য জলাশয়। এখানে শীতকালে প্রচুর অতিথি পাখি আসে।
২. লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র :
বিপিএটিসি বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। রাজধানী শহর ঢাকা থেকে ২৮ কিলোমিটার উত্তরে সাভারে অবস্থিত। এর প্রাথমিক দায়িত্ব জনসেবায় নিয়োজিত বিভিন্ন স্তরের বিসিএস ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তার প্রশিক্ষণ প্রদান। বিপিএটিসি-র প্রশিক্ষণ কোর্সের মধ্যে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সেমিনার ও কর্মশালা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিপিএটিসি-র অনুষদ সদস্যদের বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রশিক্ষণ প্রতিনিধি রূপে প্রেরণ করা হচ্ছে।
ঘ) বিনোদনমূলক :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. ফ্যান্টাসি কিংডম :
সাভারের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র আশুলিয়াস্থ কনকর্ড পরিচালিত ফ্যান্টাসি কিংডম। এখানে অনেক মজার মজার রাইডস রয়েছে। রাইডগুলোতে চড়তে ১০-৬০ টাকা পর্যন্ত লাগে।
২. নন্দন পার্ক :
নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়কের পাশে অবস্থিত অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র নন্দন পার্ক। এখানে অনেক মজার মজার রাইডস রয়েছে। এখানে রাইডসগুলো চড়তে চড়তে দিনটা কখন শেষ হবে তা বুঝাই যায়না।
৩. হেরিটেজ পার্ক :
ঐতিহ্যের মাপকাঠিতে সমৃদ্ধ আমাদের এই দেশ। হেরিটেজ পার্কে রয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানের ঐতিহাসিক নিদর্শন সমুহের ক্ষুদ্র সংস্করণ। ফ্যান্টাসি কিংডমের মধ্যেই এটি গড়ে উঠেছে।
৪. ওয়াটার কিংডম :
এখানে চলে পানির সঙ্গে খেলা। ফ্যান্টাসি কিংডমেরই একটি অংশ ওয়াটার কিংডম। এখানে ওয়েভকুল, লেজি রিভার, ফ্রামিলিকুল, স্লাইড ওয়াল্ড, টিউডয় স্লাইড এ ধরনের বেশ কিছু রাইডস রয়েছে। গ্রীষ্মের গরমে এই রাইডসগুলো চড়তে খুব মজা লাগে।
ঙ) নৌ-পর্যটন :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. বংশী নদীতে নৌ-ভ্রমণ :
বংশী নদীর অপরূপ সৌন্দর্য সাভারের সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। বর্ষকালে যখন এর নাব্যতা থাকে তখন এখানে নৌ-ভ্রমণ করা যায়।
চ) গ্রামীণ, কৃষি ও স্থানীয় ঐতিহ্য :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. সাভারের ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি :
সাভারের ঐতিহ্যবাহী ছানার মিস্টি সকলের রসনা তৃপ্তি মেটায়। এই এলাকার মিষ্টি পর্যটকদের জন্য একটি উপাদেয় খাদ্য হতে পারে।
ধামরাই উপজেলা :
ক) ধর্মীয় পর্যটন পণ্য :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. রথযাত্রা:
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব 'রথযাত্রা'। ঢাকার ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী যশোমাধবের রথযাত্রার পরিচিতি সবার কাছে। প্রতিবছর আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায় এ রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। এ দিন রথের শীর্ষ প্রকোষ্ঠে মাধবদের বিগ্রহ উঠিয়ে রথ টানা হয় এবং ওই পক্ষের নবমীতে আবার রথটি টেনে আগের স্থানে আনা হয়, যা উল্টো রথযাত্রা নামে পরিচিত। দেশের কোনো কোনো স্থানে পুরো ৯ দিনই এ রথমেলা অনুষ্ঠিত হলেও ধামরাইয়ে এ উৎসব চলে মাসব্যাপী। দেশ-বিদেশ থেকে হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার দর্শক এ উৎসবে সমবেত হয়। ১০৭৯ সাল থেকে যশোমাধব রথযাত্রা উৎসব শুরু হয়। পালবংশের শেষ রাজা যশোবন্ত পালের সময় মাটির ঢিবি খুঁড়ে মাধব মূর্তির সন্ধান মেলে। রাজা তখনকার পন্ডিত গৌর রায়কে এ মূর্তিপূজার দায়িত্ব দেন। একপর্যায়ে মাধবের নামের আগে রাজা যশোবন্ত পালের নামের অর্ধেক অংশ জুড়ে দিয়ে বিগ্রহটির নাম রাখা হয় ‘যশোমাধব। পরে পন্ডিত গৌর রায় এ ‘যশোমাধব’ মূর্তির পূজার দায়িত্ব তাঁর জামাতা রামজয় মৌলিককে দেন। এরপর এলাকাবাসী রামজয় মৌলিককে নিয়ে আসেন ধামরাইয়ে। তখন ‘যশোমাধবকে’ ঘিরে ধামরাইয়ে গড়ে ওঠে মন্দির। এরপর ওই মন্দির থেকে শুরু হয় রথাযাত্রার। রথযাত্রার সঙ্গে থাকে বিভিন্ন রকমের আয়োজন। যেমনথসার্কাস, পুতুলনাচ, যাত্রা, মৃত্যুকূপ মোটরসাইকেল ইত্যাদি।
২. মাধব মন্দির :
যশোমাধবের রথ মন্দির ধামরাই বাজার সংলগ্ন যাত্রাবাড়ি এলাকায় অবস্থিত। এখানে প্রতিবছর আষাঢ় মাসের দ্বিতীয় তিথীতে প্রায় দশদিন মেলা বসে। এই মেলায় সূদুর ভারত থেকেও অনেক পূণ্যার্থী যোগদান করে থাকেন।
খ) কৃষি, গ্রামীণ ও স্থানীয় ঐতিহ্য :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. জয়পাড়া আদর্শগ্রাম :
কুল্লা ইউনিয়নে অন্তর্গত জয়পাড়া একটি আদর্শ গ্রাম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে এলে এই গ্রাম ভ্রমণের জন্য পরিকল্পনা করা হয়। গ্রামীন আদি কাঠামো অনুযায়ী গ্রামটি গড়ে উঠেছে।
২. পিতল শিল্প :
ধামরাই পৌরসভা, তেতুলিয়া, কাছৈর ও আশ-পাশ এলাকায় ঐতিহাসিক কাল থেকে পিতল শিল্পের ছোট ছোট কারখানা গড়ে উঠেছে। এসমস্ত কারখানায় নির্মিত পিতলের থালা-বাসন, ঘটি-বাটি, গ্লাস, বদনা, পানদানি, খন্তা ইত্যাদি দেশে-বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
৩. মৃৎশিল্প :
ধামরাই সদর, হাজিপুর পালপাড়া, কাকরান ইত্যাদি গ্রামে মৃৎশিল্পের ছোট ছোট কারখানা রয়েছে। এসমস্ত এলাকায় আদিকাল থেকে মৃৎশিল্পের বিভিন্ন দ্রব্যাদি হাড়ি-পাতিল, ফুলের টপ, শো-পিস ইত্যাদি তৈরী হয়। উল্লেখ্য যে, ধামরাইতে প্রস্তুতকৃত মৃৎশিল্পের এসমস্ত দ্রব্যাদি হাইকোর্ট মাজারের সন্নিকটে পটারী মার্কেটসহ অনেক জায়গায় বিক্রি হয়।
কেরানীগঞ্জ উপজেলা :
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য নিদর্শন :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. জমিদার প্রশান্ত কর্মকারের বাড়ি :
কেরানীগঞ্জ উপজেলা সদরে এটি অবস্থিত। এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য শৈলী দর্শনার্থীদের আকৃষ্টকরে। বর্তমানে এটি উপজেলা কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
খ) ধর্মীয় পর্যটন নিদর্শন :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. আদু পাগলার মাজার :
কেরাণীগঞ্জ উপজেলায় একটি মাজার আছে যেটি আদু পাগলার মাজার বলে পরিচিত।।
নবাবগঞ্জ উপজেলা :
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্য নিদর্শন :
পর্যটন আকর্ষণ :
১. খেলারাম দাদার কোঠা :
নবাবগঞ্জ সদর সংলগ্ন কলাকোপা গ্রামে পুরাতন ঐতিহ্যবাহী ভবন রয়েছে। কথিত আছে খেলারাম একজন ডাকাত ছিল, সে বিভিন্ন অঞ্চলের ধনী ব্যক্তিদের নিকট থেকে ডাকাতি করে অর্থ সম্পদ গরীবদের মাঝে বিলিয়ে দিত। বাড়িটিতে ফুল-লতাপাতার অপূর্ব কারুকাজ দেখতে পাওয়া যায়। বাড়িটির সন্নিকটে তার সময়কার একটি প্রাচীন দিঘী রয়েছে। ব্রজনিকেতন দেখার সুবিধা আছে।
২. প্রাচীন আমলের স্থাপনাসমূহ :
কলাকোপা গ্রামে ইছামতি নদীর তীরে ১০-১২টি প্রাচীন আমলের দৃষ্টি নন্দন ভবন ও পুকুর রয়েছে। এই সমস্ত স্থাপনা পরিদর্শনের জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পর্যটক পরিদর্শনে আসে।
দোহার উপজেলা :
ক) প্রাকৃতিক :
পর্যটন আকর্ষণ :
নারিশা অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য :
নদীর সৌন্দর্য, দিগন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল, ধু ধু বালুচর ইত্যাদি পর্যটকদের সহজেই আকৃষ্ট করে। বর্ষা মৌসুমে প্রমত্তা পদ্মার নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করার জন্য নারিশা বাজার সংলগ্ন মুকসুদপুর সড়ক এবং আশ-পাশ এলাকায় প্রচুর দর্শনার্থী পর্যটকদের আগমন ঘটে থাকে।