সর্ব-শেষ হাল-নাগাদ: ৮ সেপ্টেম্বর ২০২০
মাদারীপুর জেলা
ক) ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক ও স্থাপত্যঃ পর্যটন আকর্ষণ :
১. আউলিয়াপুর/ডানলপ সাহেবের নীলকুঠিঃ
মাদারীপুর শহর থেকে ১০কি.মি. পূর্বদিকে সদর উপজেলার শিলারচর ইউনিয়নের অন্তর্গত আউলিয়াপুর গ্রাম। এ গ্রামের অন্যতম আকর্ষণ বৃটিশ আমলের নীলকুঠি। ইংরেজ নীলকর ডানলপ এ কুঠির মালিক ছিলেন। নীলকুঠি বলতে আজ যা দেখা যাবে তাহলো- ১২ কোঠা বিশিষ্ট একটি ভাঙ্গা দালান এবং ১২ মি. উঁচু একটি চিমনি। সুরকিতে ইট গেঁথে এগুলো তৈরী। এর পূর্বদিকে রয়েছে রণখোলা গ্রাম। এই রণখোলাতেই বাংলার প্রতিবাদী দুদুমিয়া ফরায়েজী নেতা হাজী শরীয়তউল্লাহ্র ফরায়েজীদের ব্রিটিশ নীলকর লাঠিয়ালবাহিনীকে মুখো-মুখি লড়াইতে পরাজিত করেছিলেন।
২. বানরের রাজ্য :
গ্রামের নাম চরমুগরিয়া। এখানে প্রায় তিন চারশ বানর দুটি দলে বিভক্ত হয়ে বসবাস করে। এরা রেসাস প্রজাতিভুক্ত। একটি দলের দখলে পশ্চিম দিক। অপর দলটির বসবাস পূর্বদিকের অংশ। কোনো দলের সদস্যই
পারতপক্ষে অন্য দলের এলাকায় যায় না। কারণ, গেলেই দু’দলে প্রচন্ড সংঘর্ষ বেঁধে যায়। তবে উভয় দলের বানরই যার যার এলাকার মধ্যে খাবারের প্রয়োজনে মানুষের ঘর ও দোকানে হানাদেয়। খেয়ালী সৃষ্টিকর্তার এ খেয়ালী রাজ্যে ভ্রমণের ব্যতিক্রমীধর্মী স্বাদ পাওয়া যায়।
৩. পর্বত বাগান :
মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামে কুমার নদীর পাড়ে ১০.৮ হেক্টর জমির উপর এক মনোরম বাগান রয়েছে। রাসবিহারী এই বাগানটি স্থাপন করেছিলেন। রয়েছে একটি জমিদার বাড়ি, ৬টি পুকুর ও নানান জাতের ফলজ গাছ। গাছে গাছে অসংখ্য পাখি। এদের সৌন্দর্য দেখে মনে হবে সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র।
৪. ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মস্থান :
ঔপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মস্থান কালকিনির কাজীবাকাই ইউনিয়নের মাইছপাড়া গ্রামে। উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক হিসেবে উনার জন্মস্থানটি পরির্দশন করেন অনেকেই।
৫. হাজী শরীয়তউল্লাহ ও দুদু মিয়ার স্মৃতি বিজড়িত স্থান :
শিবচরে রয়েছে ইতিহাসখ্যাত হাজী শরিয়তউল্লাহ ও দুদু মিয়ার স্মৃতি বিজড়িত স্থান। ফরায়েজী আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ হাজী শরীয়তউল্লাহ ১৭৭৯ সালে শিবচরের
বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র তেরো বছর বয়সে কলকাতায় চলে যান এবং হুগলীর ফুরফুরা শরীফের মাওলানা বাশার আলীর শিষ্য হন। ১৮২০ সালে দেশে ফিরে এসে ফরায়েজী আন্দোলনের শরীক হন।
ফরায়েজী আন্দোলনের প্রথম মুসলমান নেতা তিনি। ১৮৪০ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র দুদু মিয়া ফরায়েজীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাঁর কবর মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলায় অবস্থিত।
৬. খালিয়া মঠ :
রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের খালিয়া গ্রামে অবস্থিত এ প্রাচীন স্থাপত্য কীর্তিটি। পাথরাকৃতির পোড়ামাটির তৈরী মঠটি প্রায় ১০০/১২০ ফুট উচুঁ। এর শিলাখন্ডগুলো সুগ্রথিত। কোথা থেকে এর গাঁথুনি শুরু
হয়েছে তা বোঝা বেশ দূরহ। একেবারে নীচ থেকে মোটা হয়ে ক্রমান্বয়ে উপরের দিকে অল্প সরু হয়ে চূড়ার দিকে মিশে গেছে। মঠটির ছাদ সম্পূর্ণভাবে ঢালাই করা। দুই দুয়ারী এ মঠের ভেতরে গিয়ে ওপরের দিকে তাকালে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। মঠের গা জুড়ে আঁকা রয়েছে অসংখ্য ছাপচিত্র। অঙ্কিত শিলাখন্ডে দেখা যায় অনেক দেব-দেবীর মূর্তি। মঠের নির্মাণ সৌকর্য এবং এর গায়ে আঁকা মূর্তিগুলোর দৃশ্য দেখে বিমোহিত হন দর্শক-ভ্রমণবিলাসীরা। মঠটি কে কবে এবং কেন তৈরী করেছিলেন সে ব্যাপারে কোনো তথ্য প্রমাণ পাওয়া না গেলেও বিজয়স্তম্ভ হিসেবে খালিয়া মঠটি নিয়ে নানা মত থাকলেও মঠটি যে কোনো মুসলমান শাসকের নির্মিত নয়, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যায় মঠের গা-জুড়ে পোড়ামাটির ফলক ও শিলাখন্ডের মূর্তি দেখে। তবে, এ নির্মাণশৈলীর সঙ্গে মোগল স্থাপত্যকলার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। মঠটির নির্মাণ উপকরণ দেখে পন্ডিতদের অনুমান এটি ১৭ শতকের দিকে নির্মিত হয়েছিল এবং খুব সম্ভব কোনো হিন্দু সামন্তরাজ এটি তৈরী করেছিলেন।
খ) ধর্মীয় : পর্যটন আকর্ষণ :
১. আলগী কাজীবাড়ী মসজিদ :
মাদারীপুরের প্রাচীন স্থাপত্যের মধ্যে আলগী কাজীবাড়ী মসজিদ অন্যতম। এটি বাহাদুর ইউনিয়নের আলগী গ্রামে অবস্থিত। এ মসিজদের প্রাচীন ভবনটি আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। নতুনভাবে আবার তৈরী করা হলেও পুরানো কিছু ইট এর সাক্ষ্য হিসেবে রয়ে গেছে। নতুন মসজিদের পাশে একটি দীঘিও রয়েছে।
২. হযরত শাহ্ মাদারের (রঃ) দরগাহ্ শরীফ :
মাদারীপুর শহরের একপ্রান্তে কুলপদ্মী এলাকায় এ দরগা শরীফ অবস্থিত। কুলপদ্মী মাদারীপুর পৌরসভার মধ্যে অবস্থিত একটি উপশহর। একসময়ে এখানে অগণিত বানরের বাস ছিল। জনবসতি গড়ে ওঠায় এখান থেকে বানরের বিলুপ্তি ঘটে।
৩. রাজারাম মন্দিরঃ
রাজৈর উপজেলার খালিয়া গ্রামে এটি অবস্থিত। গ্রামটিতে বিশাল এক জমিদার বাড়ির পরিত্যক্ত দালান, মঠ, দীঘি, পুকুর, বাগান প্রভৃতি পড়ে আছে। তবে সেগুলোর মধ্যে একটি দোতলা মন্দির এর স্থাপত্য, শিল্পকলা ও সংরক্ষণ অবস্থার জন্য সবার দৃষ্টি কাড়ে। এটিই রাজারাম মন্দির। আয়তাকার ভিত-পরিকল্পনায় নির্মিত পূর্বমুখী এ স্থাপনার নিচের তালা উত্তর থেকে দক্ষিণে ১০.৬ মি: লম্বা এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে ৫.১৬ মিটার চওড়া। সামনে বারান্দা ও পেছনে মূর্তিকোঠা। তবে উভয় অংশই পাশাপাশি তিনটি কোঠায় বিভক্ত। কেন্দ্রীয় কোঠাটি আকারে পাশের দুটির চেয়ে বড় এবং আয়তাকার। পাশের দুটি বর্গাকার। বারান্দার বাইরের দেয়ালে পাঁচটি খিলান দরজা রয়েছে। ছোট আকৃতির ইট ও চুন সুরকীতে তৈরি এ মন্দিরের উচ্চতা ৮ মি. ৩৫ সে. মি.। কারুকাজ খচিত দেয়াল শোভাবর্ধক ইট ও পোড়ামাটির ফলক ব্যবহৃত হয়েছে। শোভাবর্ধক ইটগুলোতে খাঁজ, কলস, পুষ্পক জালি, ফুল প্রভৃতি রূপচিহ্ন ব্যবহৃত হয়েছে। পোড়ামাটির ফলকগুলোতে ঘাগড়ি করা নারী, উট, বাঘ, হাতি, গরু, শিয়াল, সিংহের মানুষ খাওয়া, শিকারীদের শিকার বহন প্রভৃতি দৃশ্য উৎকীর্ণ রয়েছে। খাঁজকাটা খিলানগুলো অলঙ্কৃৃত পার্য়াসের উপর প্রতিষ্ঠিত। এর স্থাপত্যশৈলীতে খ্রিঃ উনিশ-বিশ শতকের প্রথাসিদ্ধ ছাপ বজায় রয়েছে।
৪.মন্দিরঃ
খালিয়ার জমিদার বাড়ির দক্ষিণপূর্বাংশের বিশাল জায়গায় বর্তমানে ‘গণউন্নয়ন প্রচেষ্টা’ নামক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ‘শান্তিনিকেতন’ শিরোনামের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র অবস্থিত। প্রতিষ্ঠানটি গোটা এলাকায় সারি সারি টিনের ঘর, বিশ্রামাবাস, মসজিদ, মন্দির, লাইব্রেরি ইত্যাদি তৈরি করেছে। খোঁড়া হয়েছে একাধিক পুকুর। বাগানে লাগানো হয়েছে হাজার হাজার ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ। ছায়াঘেরা, পাখিডাকা ও কোলাহলমুক্ত এ পরিবেশে নিশ্চিন্তে হাফছেড়ে কাটিয়ে দেয়া যায় একাধিক দিন। শান্তি নিকেতনের ৪০০ মিটার উত্তরে একটি আধুনিক মন্দির আছে। এ মন্দিরে লোকনাথ বক্ষ্রচারীর সম্মানে প্রতি জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরুর দিকে তিনদিনব্যাপী এক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। মন্দিরের সামনে দূরদূরান্ত থেকে আসা ভক্ত, সন্ন্যাসী, ঋষি ও স্থানীয়দের সম্মানে সামিয়ানা টানিয়ে হ্যাজাক জ্বালিয়ে নেচে নেচে ধর্মীয় গান গাওয়া হয়।
গ) উৎসব সম্পর্কিত: পর্যটন আকর্ষণ:
১. গনেশ পাগলের মেলাঃ
রাজারাম মন্দিরের ১১ কিঃ মিঃ দক্ষিণপশ্চিমে কদমবাড়ি নামে রাজৈব উপজেলার একটি গ্রাম আছে। গ্রামটির এক প্রান্তের ‘গনেশ পাগলার আখড়া’ অবস্থিত। প্রতিবছর জৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ ও পৌষ মাসের শেষ
তিনদিন এ আখড়া ঘিড়ে বিশাল মেলা বসে। এ সময় এখানে অগনিত ভক্তের আগমন ঘটে। দূরদূরান্ত থেকে ভাগ্যাহত মানুষ বিভিন্ন মানত নিয়ে আসে। এছাড়া প্রতি মঙ্গলবার গনেশ পাগলার আখড়ায় নিয়মিত জলসা অনুষ্ঠিত হয়।
২. বাজিতপুর মেলা/মাঘী পূর্ণিমার মেলাঃ
রাজৈরের বাজিতপুর গ্রামে জমিদার রাজকুমার মজুমদারের বাড়ি। সাধক প্রণবানন্দ মহারাজ বিনোদ দাসের জন্ম এখানে। এ বাজিতপুরে একটি সেবাশ্রম রয়েছে। প্রণবানন্দ মাঠে প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমার মেলায় হাজার ভক্ত ভিড় জমায়।
৩. সেনদিয়া মেলাঃ
মাদারীপুরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সেনদিয়া মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
ঘ) প্রাকৃতিক : পর্যটন আকর্ষণ:
১. সেনাপতি দীঘি/কালকিনি দীঘিঃ
মাদারীপুর উপজেলার অন্তর্গত রাজৈর উপজেলার খাতিয়াল গ্রামের মধ্যবর্তী স্থানে ২৫০০ একর আয়তনের এক বিশাল দীঘি এ কালকিনি। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে সুবেদার ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে বিরাট একদল সৈন্য ঢাকা যাওয়ার পথে এখানে কিছুদিন অতিবাহিত করেন। পানীয় জলের অভাব মেটাতে সেনাবাহিনী কর্তৃক এ দীঘি খনন করা হয় বলে দীঘিটি সেনাপতি দীঘি নামে পরিচিত।
২. মাদারীপুর লেকঃ
মাদারিপুর শহরের কেন্দ্রস্থলে ২০ একর ভূমিতে মাদারীপুর লেক তৈরী করা হয়েছে। এটি দেখার মতো। শহরের অন্যতম সৌন্দর্যও বটে। এ লেকের পাড়ে দেখবেন লেক ভিউ ক্লাব, উদয়ের পথে শিশু বিদ্যালয়, সার্কিট হাউজ, মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন, প্রকৌশলীর কার্যালয়, অফিস আদালত, শিশুপার্ক আর স্বাধীনতা অঙ্গন। উড়িয়া এবং বিহারী মাটিকাটা শ্রমিকদের দিয়ে এ লেক কাটা হয়।