ক) ধর্মীয় পর্যটনঃ
১. খোজা মসজিদ ও বিবির মোকামঃ
মৌলভীবাজার শহরের ৪ কি. মি. দক্ষিণ পশ্চিমে গয়ঘর গ্রামে বিবির মোকাম। চার দিকে খোলা মাঠের মাঝখানে ছোট আকারের ইমারত। এর ভেতর একটি অপ্রসস্ত বর্গাকার কোঠা। চার কোনের প্রতিটিতে একটি সরু বেলুনাকার ঠেসবুরুজ আছে। প্রতিটি ঠেসবুরুজের উপর একটি করে কলস বসানো। ছাদ, উচু ঘরের উপর বসানো একটি আধা গোলাকার গম্বুজ দিয়ে ঢাকা। দক্ষিণ ও পূর্ব দিকে একটি করে খিলান দরজা রয়েছে। নাম ও তীর থেকে অনুমিত হয় যে, এটি কারবালার স্মৃতিচারণ স্বরূপ শিয়া সপ্রদায়ের নির্মিত একটি স্থাপনা। এর স্থাপত্য শৈলীতে খ্রি: আঠার-ঊনিশ শতকের প্রথাসিদ্ধতা বজায় রয়েছে।
২. শাহ আরেফিনের মাজারঃ
যাদুকাটা নদীর তীরে পাহাড়ের পাদদেশে প্রখ্যাত সুফী শাহ আরেফিন শাহ এর মাজার অবস্থিত। এখানে প্রতি বছর ওরশ উপলক্ষ্যে বিপুল সংখ্যক ভক্তের জমায়েত হয়।
৩. হযরত শাহ মোস্তফা (রঃ) এর মাজার শরীফঃ
হযরত শাহজালাল (রঃ) এর অন্যতম অনুসারী হযরত শাহ মোস্তফা (রঃ) হযরত আলী (রাঃ) এর বংশধর ছিলেন। তিনি প্রায় সাতশত বছর আগে এই জেলার মোস্তফাপুর এ বসতি স্থাপন করে এ এলাকায় ইসলামধর্ম প্রচার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করেন।
খ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলকঃ
১. বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধঃ
কমলগঞ্জ উপজেলার ধলই সীমান্তে অবস্থিত এই স্মৃতিসৌধ দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানের স্মরণে নির্মিত। বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমানকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।
২. মনিপুরী পল্লীঃ
মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে ৩৫ কিঃমিঃ দুরে কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মনিপুরীদের অন্যতম আবাসস্থল আদমপুর ও মাধবপুর। এখানে পাহাড় -পর্বত এবং অরণ্য ভূমির নয়নাবিরাম দৃশ্যাবলী মানুষের মনকে যতটানা আকৃষ্ট করে তার চেয়েও বেশী আকৃষ্ট করে মনিপুরিদের বৈচিত্রময় জীবন প্রণালী। মাধরপুরে ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি মনিপুরী সাংস্কৃতিক একাডেমি রয়েছে ।
৩. নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীঃ
এ জেলায় বেশকিছু নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। তারমধ্যে মনিপুরী, খাসিয়া, সাঁওতাল, টিপরা উল্লেখযোগ্য। এ সকল নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ঠসহ রয়েছে নিজস্ব ঐতিহ্য ও বৈচিত্রময় জীবনধারা।
গ) উৎসব সম্পর্কিতঃ
রাস মেলাঃ
কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রতি বছর নভেম্বর মাসে অগ্রাহায়ণের শুরুতে মনিপুরী পল্লীতে বসে বর্ণাঢ্য রাস মেলা । রাস মেলায় দেশ বিদেশ থেকে অসংখ্য দর্শণার্থীর আগমন ঘটে । মেলা উপলক্ষে বিখ্যাত মনিপুরী নৃত্যের আয়োজন করা হয়। এ সময় মনিপুরীদের উন্নত সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। মেলা উপলক্ষে মনিপুরীদের নিজেস্ব তাঁতে বোনা ঐতিহ্যবাহী মনিপুরী শাল, চাদর, ব্যাগ ,ফতুয়া ইত্যাদি বেচা কেনা হয়।
ঘ) নৌ-পর্যটনঃ
হাকালুকি হাওড়ঃ
বাংলাদেশের বৃহত্তম হাওড়। এটি মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলায় অবস্থিত। এর নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। বহু বছর পূর্বে ত্রিপুরার মহারাজ ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘রুকি দেয়’ অর্থাৎ লুকিয়ে থাকে। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঐ এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’। প্রায় দুই হাজার বছর আগে প্রচন্ড ভূমিকম্পে ‘আকা’ নামে এক নৃপতি ও তার রাজত্ব মাটির নিচে তলিয়ে যায়। কালক্রমে এই তলিয়ে যাওয়া নিম্নভূমির নাম হয় ‘ধাকালুকি বা হাকালুকি’। হাওরের আয়তন ১৮১.১৫ বর্গ কিমি। এখানে প্রতি বছর শীতকালে ২০০ বিরল প্রজাতীর অতিথি পাখির সমাগম হয়। হাকালুকি হাওর টেকসই উন্নয়ন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণ, ইকোটুরিজম শিল্প বিকাশের এক অসাধারণ আধার।
ঙ) প্রাকৃতিকঃ
১. লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানঃ
মৌলভীবাজার জেলা সদর হতে ৩০ কিঃমিঃ দুরে কমলগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ১২৫০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই উদ্যান অবস্থিত। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনন্য লাউয়াছড়া উদ্যান জীববৈচিত্র্যে ভরপুর । এখানে এখনও টিকে রয়েছে লজ্ঝাবতী বানর, উল্লুক, হনুমান, কুল বানর এর মত বেশ কিছু বিরল প্রজাতির পশুপাখি।
২. মাধবকুন্ড জলপ্রপাতঃ
সিলেট থেকে ৭০ কিঃমিঃ এবং মৌলভীবাজার সদর থেকে ৭২ কিঃমিঃ দূরে বড়লেখা উপজেলায় দেশের সর্ব বৃহৎ জলপ্রপাত মাধবকুন্ড অবস্থিত। এখানে ৮৩ মিটার উচুঁ পাহাড়ের উপর থেকে জলরাশি অবিরাম ধারায় নিচে পড়ছে। প্রতি দিন অসংখ্য পর্যটক আগমন করে এখানে । ভূতাত্ত্বিকভাবে এই জলপ্রপাত পাথারিয়া ভূখন্ডে অবস্থিত এবং ভূবন স্তরসমষ্টির শিলায় গঠিত। জলপ্রপাতের কাছে পিকনিক স্পট, রেস্তোঁরা ও পার্কিং সুবিধা গড়ে তোলা হয়েছে।
৩. মাধবকুন্ড ইকোপার্কঃ
সিলেট বন বিভাগের আওতাধীন জুড়ী-২ রেঞ্জের বন বিটে মাদবকুন্ড ইকোর্পাক অবস্থিত। মাধবকুন্ড জলপ্রপাতসহ বিশাল পাথর এবং বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি ও বিভিন্ন বন্য প্রাণীর পদচারনায় মুখরিত এই ইকোর্পাক।
৪. মাধরপুর চা বাগান ও লেকঃ
মৌলভীবাজার জেলা সদর হতে প্রায় ৫০ কিঃমিঃ দুরে কমলগঞ্জ উপজেলায় মাধরপুর চা বাগান ও লেকটি অবস্থিত । মাধবপুর চা বাগানের মধ্যে কৃত্রিমভাবে তৈরী মাধবপুর লেক এ লেকে রয়েছে প্রচুর নীল শাপলা ও পদ্ম ফুল। চা বাগানের নৈসর্গিক পরিবেশে লেকের পানিতে দেশী নৌকায় নৌবিহার করা যায়। শীত মৌসুমে এ লেকে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির সমাগম হয়। লেকের চারিদিকে উচুঁ টিলার উপর চা বাগানটি খুবই আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট।
৫. চা-বাগানঃ
মৌলভীবাজার জেলার বিস্তৃত অঞ্চলে ছোট বড় টিলা , পাহাড় ও সমতলে ৯২ টি চাবাগান রয়েছে। প্রতিটি চা বাগানে রয়েছে সবুজের সমাহার, অপরুপ সৌন্দর্য, বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখি যা সহজেই পর্যটকদের দৃষ্টি আর্কষণ করে।
৬.বর্ষিজোড়া ইকোপার্কঃ
মৌলভীবাজার সদর উপজেলায় এই ইকোর্পাক অবস্থিত। প্রকৃতিপ্রেমি পর্যটকদের জন্য এটি একটি অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
৭. মনু ব্যারেজঃ
১৭৪ কিঃমিঃ র্দীঘ মনু নদী ভারতীয় এলাকা অতিক্রম করে এ জেলার গবিন্দপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বন্যার প্রকোপ থেকে ৫৪০ বর্গ কিঃমিঃ এলাকা রক্ষার জন্য মনু ব্যারেজ তৈরী করা হয়। এ ব্যারেজে একটি খননকৃত মনোরম লেক আছে যেখানে পর্যটকদের জন্য প্যাডের বোটে পরিভ্রমণের ব্যবস্থা আছে।
৮.টিলা জুরিঃ
জুরিতে দেখা যাবে চা-বাগানের ছড়াছড়ি। মনে হবে সারা জুরি এলাকা যেন চা-বাগানে ছেয়ে আছে।
চ) সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলকঃ
বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনষ্টিটিউটঃ
মৌলভীবাজার শহর থেকে আনুমানিক ২৫ কিঃমিঃ দূরে দেশের চা রাজধানী খ্যাত শ্রীমঙ্গল উপজেলায় ১৯৫৭ সালে এই চা গবেষনা প্রতিষ্ঠানটি স্থাপন করা হয়। দেশের গর্ব এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চায়ের গবেষণার মাধ্যমে তার অবস্থান সুসংহত করেছে।
ছ) প্রাকৃতিকঃ
১. চা বাগানঃ
শ্রীমঙ্গলের অন্যান্য দর্শনীয় চা স্থানগুলোর মধ্যে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ চা-বাগান রেইন ট্রি অন্যতম। কম করে হলেও এ এলাকায় ১০৫টি চা-বাগান আছে। চা রাজধানী নামে পরিচিত মাইলের পর মাইল ছেঁটেকেটে পরিপাটি করে রাখা ৬০ সে.মি. থেকে ৭০ সে.মি. উঁচু কার্পেটে ঢাকা চা-বাগান। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু আবার কোথাও ঢালু। সবচেয়ে মনোরম বাগানটির নাম রাজঘাট ও ফিনলে চা-বাগান। শ্রীমঙ্গলে একটি চা-গবেষণা ইনস্টিটিউট আছে।
২. মনীপুরি গ্রাম টিলাঃ
আনারস ও লেবু বাগানঃ
শ্রীমঙ্গলের অন্যতম আকর্ষন আনারস ও লেবু বাগান। পাহাড়ের ঢালে আনারসের বাগান পরিদর্শনের জন্য অনেক পর্যটকদের আগমন ঘটে।
৩. হাইল হাওরঃ
শ্রীমঙ্গলের একাংশ জুড়ে এ হাওর। শীতের মৌসুমে জেগে ওঠা বিলগুলোর মধ্যে বাইক্কা, চাপড়া, মাগুরা ও জাদুরিয়া অন্যতম। এ বিলগুলো অতিথি পাখির জন্যে বিখ্যাত। হাইল হাওরে ১০১ হেক্টর জায়গা জুড়ে মাছের অভয়ারণ্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া বিলের পূর্ব প্রান্তে ৯মি. ৪৪ সে.মি. উঁচূ পর্যবেক্ষণ বুরুজ আছে।
৪. পাথরিয়া-মাধবকুন্ডঃ
বড়লেখা উপজেলায় এর অবস্থান। এটি উপজেলা শহর থেকে ১২ কি. মি. দূরে লাউয়াছড়ার ২৭ কি. মি. পর্যন্ত বিশাল এক পাহাড়। পাহাড়টি ৪০ কিঃমিঃ লম্বা। বড়লেখার অন্তর্গত পাহাড়টি একাংশ পাথরিয়া এবং অপরাংশ মাধবকুন্ড ‘মাধবছড়া’ নামে পরিচিত। এছাড়া এখানে রয়েছে পর্যটন আকর্ষণীয় মাধবকুন্ড জলপ্রপাত এবং ইকো পার্ক।
৫. লাউয়াছড়াঃ
শ্রীমঙ্গলের কমলগঞ্জ উপজেলার লাউয়াছড়া নিবিড় বন। এটি রেইন ফরেস্ট নামেও পরিচিত। এ ধরনের বনের বৈশিষ্ট হল গাছের কান্ডগুলো ডালপালা বিহীনভাবে বেশ উঁচু হয়ে ওঠে। এ বনের বিস্তৃতি ১,২৫০ হেক্টর। এটিকে সম্প্রতি ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং বড় আকারের রেইন ফরেস্টগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। এর পত্তন হয়েছিল প্রায় ১০০ বছর আগে বৃটিশ শাসনামলে। এ বনে প্রায় ১৬৭ প্রজাতীর উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতীর উভচর, ৬ প্রজাতীর সরীসৃপ, ২০ প্রজাতীর স্তন্যপায়ী ও ২৪৬ প্রজাতীর পাখি রয়েছে। বিশাল বিশাল কয়েকটি পাহাড় কেন্দ্র করে এই বন। বনের ভিতরে ৩টি পায়ে চলার পথ রয়েছে। স্থানীয় ভাষায় একে বলে ‘ছড়া’। এর আরেকটি অন্যতম আকর্ষণ লাউয়াছড়া খাল।
৬. সিদ্ধার্থ নিমাইশিব বাড়িঃ
শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ৫ কি. মি. দক্ষিণ পূর্বে অবস্থিত। এখানে যাওয়ার পথে পড়বে একটি মরা নদীর বালি ভরা বুক। তার একটি সুন্দর দীঘি নাম ‘নিরাময়ী’। এর চারপাশে মেহগনি ও আকাশমনি গাছে ঘেরা। পাশে একটি টিলা। এর চূড়ায় উঁচু মঞ্চের উপর টিনের ছাউনি দেয়া একটি স্থাপনা। সামনে চওড়া সিঁড়ি। ভেতরে শিবলিঙ্গের পূজা হয়। এর নাম ‘ধাপেশ লিঙ্গ’। এর সাথে এক বিধবার স্বামী-সাধনার কাহিনী জড়িত।