পাহাড়পুর নওগাঁ জেলা এবং বদলগাছী থানার অধীনস্থ পাহাড়পুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। স্থানীয়ভাবে পাহাড় নামে পরিচিতি লাভকারী এ ধ্বংসাবশেষের অবস্থান থেকে পাহাড়পুর নামের উৎপত্তি হয়েছে। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগের খননের ফলে সোমপুর মহাবিহার শীর্ষক উত্তর-দক্ষিণে ২৭৪.১৫ মিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ২৭৩.৭০ মিটার পরিমাপ বিশিষ্ট এক বিরাট বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংসাবশেষ আবি®কৃত হয়েছে। এই স্থাপনার চতুর্দিকে বাসোপযোগী কক্ষ, বিস্তৃত প্রবেশপথ, অসংখ্য নিবেদন-স্তুপ, ছোট ছোট মন্দির, পুষ্করিণী ও সংলগ্ন অন্যান্য নিদর্শন ছাড়িয়ে রয়েছে, মাঝে রয়েছে স্থাপত্য-বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুউচ্চ একটি মন্দির। মন্দিরের দেয়াল গাত্র কার্নিস, পোড়ামাটির ফলকচিত্র এবং প্রস্তর ভাস্কর্য দ্বারা সুশোভিত।
২.হলুদ বিহার :
পাহাড়পুর হতে ১৫ কিঃমিঃ দক্ষিণে, মহাস্থান হতে ৫০ কিঃমিঃ উত্তর-পশ্চিমে এবং নওগাঁ জেলা শহর হতে ১৮ কিঃমিঃ উত্তরে বদলগাছি উপজেলার বিলাসবাড়ি ইউনিয়নে তুলসীগঙ্গা এবং যমুনা নদীর মাঝখানে অবস্থিত হলুদবিহার । এখানে অনেকগুলি বিক্ষিপ্ত প্রাচীণ ঢিবি এক বিশাল এলাকা জুড়ে বিদ্যমান। ষথানীয়ভাবে দ্বীপগঞ্জ নামে পরিচিত সম্পূর্ণ গ্রামটিতে প্রচুর পুরানো ইট,ভাঙ্গা মৃৎপাত্র ও অন্যান্য ধ্বংসাবশেষ অগোছালোভাবে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। এ পুরানো ঢিবিগুলি এবং গ্রামের নাম থেকে ধারণা করা যায় যে, এখানে প্রাচীন বৌদ্ধ বসতি ছিল। পাথর এবং ধাতু নির্মিত মূর্তি, পোড়ামাটির ফলক, অলংকৃত ইট প্রভৃতি প্রাচীন নিদর্শন এস্থানে পাওয়া গেছে। এলাকার সর্বত্রই প্রাচীন দালান-কোঠার নিদর্শন বিদ্যমান। স্থানটি ১৯৭৬ সালে সংরক্ষিত করা হয় এবং বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রথমে ১৯৮৪ সালে এবং পরে ১৯৯৩ সালে এলাকাটি খনন করার ফলে একটি মন্দির কমপ্লেক্স আবিস্কৃত হয়। বরেন্দ্র অঞ্চলের পাহাড়পুর ও সীতা কোটের ধ্বংসাবশেষের সমসাময়িক।
৩.সত্যপীরের ভিটা :
নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার অধীনে পাহাড়পুর বিহার থেকে ৩৬৫ মিটার পূর্বে অবস্থিত। এ ভিটায় একটি তারা মন্দির এবং বিভিন্ন আকার ও আয়তনের প্রচুর স্তুপের ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। মন্দির অঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৫০টি পোড়ামাটির ফলক, আটহাত বিশিষ্ট দেবীমূর্তি ও বৌদ্ধ ধর্মীয় মতবাদ লিপি খোদিত পোড়ামাটির গোল সীলগুলি থেকেই এই ভিটা ও তারা মন্দিরের অভিন্নতা প্রতিপন্ন হয়েছে। প্রত্নস্থলটি আকৃতিতে একটি অসমান্তরাল বাহু বিশিষ্ট চতুর্ভূজ। এর দৈর্ঘ্য ৭৬ মিঃ থেকে ৯১ মিঃ এবং প্রস্থ ৪৩ মিঃ থেকে ৫৭ মিঃ। এ মন্দির এলাকায় ১৩২টি নিবেদন স্তুপ আছে। এখানকার স্তুপগুলোর মধ্যে প্রধান মন্দিরের কাছাকাছি অঙ্গনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত চতুষ্কোণ স্তুপটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। খননের ফলে এই স্তুপের মধ্যস্থলে ১ মিঃ বর্গ বিশিষ্ট একটি বাঁধানো স্মারক কুঠুরি আবিস্কৃত হয়েছে। সত্যপীরভিটায় আবিস্কৃত প্রধান প্রত্নবস্তুগুলি হলো পোড়ামটির ফলকচিত্র, অলংকৃত ইট এবং পাথরের গুটিকা। এছাড়া কিছু তারামূর্তি, ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি জম্ভল মূর্তি এখানকার অন্যতম উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার।
৪. জগদ্দল মহাবিহার :
বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল রাজাদের চারশতাব্দীব্যাপী গৌরবময় রাজত্বকালে তাদের সামরাজ্যের সর্বত্র বিভিন্ন রাজারা অসংখ্য বৌদ্দ মঠ, মন্দির ও স্তুপ নির্মাণ করেছিলেন। জগদ্দল মহাবিহার নির্মাণ করেন সম্ভবত রামপাল (১০৭৭-১১২০) জগদ্দল গ্রামের এক বৃহৎ অংশ জুড়ে রয়েছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত প্রাচীন ঢিবি ও পরিত্যক্ত পুকুর। জয়পুরহাট-ধামইরহাট মহাসড়কের হারিটতকীডাঙ্গা বাজারের তিন উপজেলা কার্যালয়ের ৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এর অবস্থান। জগদ্দল গ্রামের বিশাল ঢিবিতে ১৯৯৬ সালে পরিচালিত সংক্ষিপ্ত খনন কার্যের ফলাফল উৎসাহব্যঞ্জক হলেও চূড়ান্ত নয়। জগদ্দল মহাবিহারের অবস্থান, সম্ভাব্য সময়কাল এবং ধ্বংসাবশেষের পরিব্যাপ্তি এখনও অনুমানসাপেক্ষ।
৫. পতিসর :
রবীন্দ্রস্মৃতি বিজড়িত উত্তর বঙ্গের নওগাঁ জেলার অন্তর্গত আত্রাই উপজেলাধীন একটি গ্রাম। জেলা শহর থেকে ২৬ কি:মি: এবং আত্রাই রেল স্টেশন থেকে ১২ কি:মি: দক্ষিণ-পূর্ব দিকে নাগর নদীর তীরে গ্রামটি অবস্থিত। জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জমিদারির কালিগ্রাম পরগণার সদর কাচারি ছিল এই পতিসরে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং জমিদারি দেখাশোনার জন্য ১৮৯১ সালের জানুয়ারীতে প্রথম পতিসরে আসেন। পতিসরের দোতলা কুঠিবাড়ির স্থাপত্যশৈলী শিলাইদহ ও শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ির অনুরূপ। ‘রবীন্দ্রসরোবর’ নামের পুকুরটি এখন মজা ডোবায় পরিণত হয়েছে। পতিসরের কুঠিবাড়ি ও পদ্মাবোটে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ নানা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ছিন্নপত্রের অনেক চিঠি এবং বিদায় অভিশাপ কাব্যনাট্য রচনা করেন। এছাড়াও কবি পল্লীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য স্থাপন করেন বহু পাঠশালা, রবীন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, পতিসর কৃষিব্যাংক (১৯০৫) ইত্যাদি। কৃষির উন্নতির জন্য তিনি পতিসরের মাঠে কলের লাঙ্গল চালিয়েছেন; গড়ে তুলেছিলেন কৃষি, তাঁত ও মৃৎশিল্পের সমবায় সংগঠন। তাঁর নোবেল পুরস্কারের এক লক্ষ টাকাও তিনি পতিসর কৃষিব্যাংকে দিয়েছিলেন। পতিসর এখন একটি দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে।
৬. ভীমের পান্টিঃ
নওগাঁ জেলা শহর হতে ৬৭ কিঃমিঃ ধামইরহাট উপজেলায় অবস্থিত স্তম্ভটি বিষ্ণুর পাল রাজা নারায়ন পালের সময় নির্মাণ করা হয়।
৭. দিবর স্তম্ভ (মহারাজ দিব্যের বিজয় স্তম্ভ) :
জেলা শহর থেকে ৫৭ কিঃমিঃ দূরে পত্নীতলা উপজেলায় অবস্থিত হাজার বছরের পুরাতন একটি জলাশয়ের মধ্যে প্রায় ৪১ ফুট উচ্চ এবং ১০ ফুট ব্যাস বিশিষ্ঠ অষ্টভূজাকৃতি গ্রানাইট পাথর নির্মিত এই স্তম্ভ দেখা যায়। এই স্তম্ভ দেখতে প্রতিদিন এই স্থানে প্রচুর পর্যটক আগমণ করেন।
খ) ধর্মীয় :
পর্যটন আকর্ষণের নাম ও বর্ণনা :
১. কুসুম্বা মসজিদ :
আত্রাই নদীর পশ্চিমে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার অন্তর্গত কুসুম্বা গ্রামের নামানুসারে পরিচিত। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আঙ্গিনার ভেতরে মসজিদটি অবস্থিত।। এ আঙ্গিনায় প্রবেশের জন্য রয়েছে আকর্ষণীয় একটি প্রবেশদ্বার। গিয়াসউদ্দীন বাহাদুর শাহ এর রাজত্বকালে জনৈক সুলায়মান মসজিদটি নির্মাণ করেন। পূর্বদিকের কেন্দ্রীয় প্রবেশদ্বারের উপরে স্থাপিত একটি শিলালিপি অনুসারে এ মসজিদটির নির্মাণকাল ৯৬৬ হিজরি (১৫৫৮-৫৯ খ্রি:)। এ মসজিদটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে কর্তৃক সংরক্ষিত। মসজিদটির মূল গাঁথুনি ইটের তৈরী হলেও এর বাইরের দেয়াল সম্পুর্ণ এবং ভিতরের দেয়ালে পেন্ডেন্টিভের খিলান পর্যন্ত পাথরের আস্তরণ দিয়ে আবৃত। মিহরাবগুলি খোদাইকৃত পাথরের নকশা দিয়ে ব্যাপকভাবে অলংকৃত।
২. মাহি সন্তোষ মসজিদ :
মাহীসন্তোষ মসজিদ নওগাঁ জেলার ধামইর হাট থানা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিঃমিঃ উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত। ২.২০ মিঃ পুরু দেয়াল বিশিষ্ট আয়তাকার মসজিদটির চারকোণে চারটি অর্ধ অষ্টভুজাকার পার্শ্ববুরুজ ছিল। মসজিদে প্রবেশের জন্য সম্মুখভাগে ৫টি (খিলনাযুক্ত) প্রবেশপথ ছিল এবং উত্তর ও দক্ষিণের প্রতি পার্শ্বে তিনটি করে প্রবেশ পথ ছিল। ঘনক আকৃতির পাথরের ভিত্তির উপর প্রতিটি স্তম্ভ ছিল দন্ডায়মান। বর্গাকার প্রতিটি স্তম্ভের দন্ড তিনটি অংশে বিভক্ত। সর্বনিম্ন অংশের পরিমাপ ০.৪০ মি এবং এর গায়ে ছিল ক্রিকোনাকার নকশা। দশবাহু বিশিষ্ট মাঝের অংশের পরিমাপ ১.৫৫ মি। সবচেয়ে উপরের বহুভুজ (১৬ বাহু বিশিষ্ট) আকৃতির অংশটির পরিমাপ ০.৯৬ মি। এই অংশে শিকল ও ঘন্টার নকশা এবং অর্ধবৃত্তাকার ঝুলন্ত মুক্তার নকশা রয়েছে। মসজিদের কেন্দ্রীয় ‘নেভ’ পাশের অংশ অপেক্ষা বড় এবং তিনটি আয়াতার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। এগুলির ছাদ বাংলা চৌচালা রীতির খিলান ছাদে আচ্ছাদিত ছিল। আর এর দুপাশের অংশদুটি সম্ভবত আচ্ছাদিত ছিল সর্বমোট ১২টি অর্ধগোলাকার গম্বুজে। আচ্ছাদনের এই ব্যবস্থা বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ এর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
গ) বিনোদনমূলক :
পর্যটন আকর্ষণের নাম ও বর্ণনা :
১. আলতাদিঘী :
নওগাঁ জেলায় ধামইরহাট উপজেলায় সংরক্ষিত বনের মাঝে আলতাদিঘী নামে এই দিঘীটি বিদ্যমান। এই দিঘীর ন্যায় বৃহৎ ও মনোমুগ্ধকর দীঘি আর নাই । পাড়সহ এই দিঘীর মোট আয়তন ৫৫.৪৫ একর। দিঘীর দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ে বিশাল শালবাগান ঘেরা দীঘিটির সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করেছে। রাজা বিশ্বনাথ তার রাজত্বকালে এতদাঞ্চলের পানির অভাব পুরণের জন্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে এই বিশাল দিঘী খনন করান। প্রকৃতিপ্রেমী প্রচুর দর্শনার্থী প্রতিদিন এস্থান ভ্রমণ করেন।
ঘ) উৎসব সম্পর্কিত :
পর্যটন আকর্ষণের নাম ও বর্ণনা :
রবীন্দ্র জন্মোৎসব :
দেশ-বিদেশের বহু রবীন্দ্রভক্ত প্রতিবছর রবীন্দ্রস্পর্শধন্য পতিসর পরিদর্শনে আসেন। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে এখানে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রবার্ষিকী অনুষ্ঠানমালার অংশ হিসেবেও পতিসরে রবীন্দ্রজন্মোৎসব পালিত হয়।